সালটা ২০২০, প্রবল লকডাউনের মধ্যে আচমকাই মায়ের দেহের অক্সিজেন কমে ৪২। প্রতি মিনিটে মিনিটে সেটা আরও কমছে। অক্সিজেন ক্যানের সাহায্যে ঠেকনা দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। বাড়ির সবাই অনুমান করেছিল বুঝি করোনা। কিন্তু চিকিৎসক বললেন হার্ট ফেলিওর। পরে জানা গেল কিডনিতেও প্রভাব ফেলেছে। সেই প্রথম এই রোগের ভয়াবহতার মুখোমুখি। তবে আমি নই, আজকাল বাড়িতে বাড়িতে অনেকেই এই বিপদের সম্মুখীন। হার্ট ফেলিওর আজকাল জ্বর, কাশির মতো হয়ে গিয়েছে। আর এই রোগ একা আসে না। সে আবার সঙ্গে করে কিডনিকেও প্রভাবিত করে, এবং রেনাল ফেলিওরের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে। এটাকে যৌথ ভাবে বলা হয়ে থাকে কার্ডিও-রেনাল সিনড্রোম বা সিআরএস।
কেন হয় এই কার্ডিও-রেনাল সিনড্রোম?
একাধিক কারণের মধ্যে অন্যতম হল হার্টের অসুখ থাকলে হার্টের জন্য ওষুধ খেতে হয়। আর সেই ওষুধ খেতে খেতে সেটা অনেক সময়ই কিডনিকে এফেক্ট করে। হার্ট ফেলিওর হলে তাই অনেক সময়ই কিডনি ফেলিওর হয়। কিন্তু সবসময় নয়। এবার প্রশ্ন হার্টের সমস্যা থাকলে কাদের কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে? কাদের কাদের ক্ষেত্রে এই কার্ডিও-রেনাল সিনড্রোম হতে পারে? এতদিন এই বিষয় কিছুই জানা যেত না। কিন্তু এবার সেই বোঝার বন্ধ দরজা খুলে নতুন আলোর দিশা দেখালেন এক বঙ্গতনয়া। তাঁর গবেষণা চিকিৎসাবিজ্ঞানের আরও একটা নতুন দিক খুলে দিল।
এই বঙ্গতনয়ার আবিষ্কারের হাত ধরেই কার কিডনি অকেজো হবে, কখন হবে সেই সমস্ত পূর্বাভাস দেওয়া যাবে।
এমিলি চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণা
হার্ভাড মেডিক্যাল স্কুলের গবেষক এমিলি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে HT বাংলার তরফে এই বিষয় নিয়ে যোগাযোগ করা হয়। তিনি তাঁর গবেষণা প্রসঙ্গে জানান, তাঁদের গবেষণার ফাইন্ডিং দুটো। এবং বাকি একাধিক গবেষণার থেকে অনেকটাই আলাদা। তিনি আরও জানান এতদিন চিকিৎসকরা জানতেন না যে কাদের হার্টের অসুখ হলেই রেনাল প্রবলেম হবে, এই অত্যাধুনিক মডেলের সাহায্যে তাঁরা সেটা আবিষ্কার করেছেন। এমিলির কথায়, 'এতদিন কোনও ওষুধ বানাতে গেলে বা চিকিৎসাবিজ্ঞানের কিছু আবিস্কার করতে গেলে ল্যাবরেটরিতে আগে পশু যেমন প্রথম ইঁদুর তারপর গিনিপিগ, তারপর শিম্পাঞ্জি বা বাঁদরের উপর পরীক্ষা করা হতো। সেই সমস্ত ধাপে পাশ করার পর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হতো। ফলে বুঝতেই পারছেন প্রসেসটা বেশ লম্বা। ১০-১২ বছর তো লেগেই যেত। সঙ্গে বিপুল খরচের একটা বিষয় থাকত। আবার সব এক্সপেরিমেন্ট বা গবেষণা যে সফল হয় এমনটা নয়। খুব কম শতাংশ এক্সপেরিমেন্ট ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অবধি পৌঁছত। কিন্তু এই কার্ডিও-রেনাল সিনড্রোমের জন্য তেমন কোনও ঠিকঠাক অ্যানিমাল মডেল নেই।'
কী এই অত্যাধুনিক মডেল?
গবেষক এমিলির কথায় এই মডেলের নাম অরগ্যান অন কিট। বিগত কয়েক বছর ধরে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে এটা যে এক্সপেরিমেন্টের জগতে বেশ নতুন সেটা বলা যায়।
অরগ্যান অন কিট পদ্ধতিতে কী করা হয়?
যে কোনও অঙ্গের একটা মিনিয়েচার বানিয়ে সেটার উপর পরীক্ষা করা হয়। এমিলি জানান, 'আমাদের গবেষণায় আমরা ২ সেন্টিমিটারের একটি কিডনি বানিয়ে সেখানে পরীক্ষা করেছি। আর এখানেই দেখা গিয়েছে এক্সট্রা সেলুলার ভেসিকেল বেরোচ্ছে। সেটাই আখেরে ক্ষতি করছে কিডনির।'
এই এক্সট্রা সেলুলার ভেসিকেল কী?
দেহের বিভিন্ন কোষ থেকে মাইক্রো বা ন্যানো সাইজের পার্টিকেল বেরিয়ে আসে, সেটাই গিয়ে কিডনিকে এফেক্ট করে। হার্ট ফেলিওর রোগীদের ক্ষেত্রেই মূলত এটা দেখা যায়। এটা একটা বায়োমার্কার, এটা সাহায্যে আগামীতে বোঝা যাবে কাদের কিডনির ক্ষতি হতে পারে, কাদের নয়।'
আরও পড়ুন: হার্টের স্নায়ু নষ্ট হতে পারে একটিমাত্র রোগেই! সময় থাকতে কোন কাজটি না করলেই নয়
আরও পড়ুন: কম বয়সে হার্ট অ্যাটাকের নেপথ্যে একটি বড় রোগ! কী বলছেন চিকিৎসকরা
কী করে বুঝবে?
যে রোগীর রক্তে এই এক্সট্রা সেলুলার ভেসিকেল থাকবে তার কিডনি ফেলিওর হওয়ার চান্স বেশি। এটা একটি কিটের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা যাবে।
কী কী সাহায্য হল এই গবেষণায়?
এমিলিদের এই গবেষণার পর থেকে অ্যানিম্যাল মডেল আর ব্যবহার করতে হবে না যে সেটা স্পষ্ট। ফলে টাইম, খরচ সব বাঁচবে। একই সঙ্গে হার্টের রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেকটাই সাহায্য হবে।
এমিলি জানান তিনি এই গবেষণার মুখ্য লেখক ছিলেন। তাঁর সঙ্গে হেলসিঙ্কি এবং ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য গবেষকরাও ছিলেন। তাঁর এই গবেষণাপত্র জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল ইনভেস্টিগেশন ইনসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
প্রতি বছর ৫৫ লাখ মানুষ হার্ট ফেলিওরের শিকার হন বিশ্বজুড়ে। এর ৩৪.৪ শতাংশ মানুষের আবার কিডনির সমস্যা দেখা যায়। ফলে এই কিট এলে এক্সট্রা সেলুলার ভেসিকেল রক্তে চিহ্নিত করা গেলে অনেক রোগীকে সঠিক চিকিৎসা এবং আগাম পদক্ষেপ নিয়ে সুস্থ রাখা যাবে।