ইনি আর এক রবি। তবে ঠাকুর নন, বরং সুরের শঙ্কর। ভারতের ধ্রুপদী সঙ্গীতের সব চেয়ে বড় আইকন যদি কাউকে এক নিমেষে বলা যায়, তিনি হলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। বৃহস্পতিবার, ৭ এপ্রিল রবিশঙ্করের ১০২তম জন্মবার্ষিকীতে ফিরে দেখা ওঁর জীবন, সাদা কালোর আতস-কাঁচে, এক আবেগপ্রবণ প্রতিভাধর বাঙালিকে। কিংবদন্তিরা কেউ ছোট-বড় হন না, শুধু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গোল পোস্টের জায়গা বদলে যায়। কিন্তু এই রবিকিরণে আলোকিত হয়েছেন সবাই, আলোকিত হয়েই চলেছেন অনেকে… ভবিষ্যতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ওঁর সৃষ্টিকে সঙ্গী করেই এগোবে। তবে রক্ত মাংসের রবিশঙ্কর কেমন ছিলেন?
সেবার এক অনুষ্ঠান হচ্ছে বারাণসীতে। দর্শকের মধ্যে উপস্থিত এক মহিলা সুরের মূর্চ্ছনার মধ্যেই উল বুনে চলেছেন। সেতার থামিয়ে দিলেন পণ্ডিতজি। চিৎকার করে বলে দিলেন যে, হয় ওঁর আঙ্গুল কাজ করবে, নইলে তাঁর। যেমন কথা, তেমন কাজ…
নিস্তব্ধতা ঠিক এতটাই ভালোবাসতেন রবিশঙ্কর। শৈশবে বড় হওয়া এই বারাণসীতেই। বিখ্যাত দাদার থেকে নাচের তালিম পেলেও নর্তক হওয়া হয়নি। সেই নিয়ে অবশ্য কারও আফসোস নেই। জন্ম বর্ধিষ্ণু পরিবারে হলেও শৈশবে মা আর দাদার কাছে বড় হওয়া বেশ অন্য রকম ছিল।
পথের পাঁচালীর সেই দৃশ্য। হরিহর বাড়ি ফিরে এসেছেন। অপু-দুর্গাকে ডাক দিয়েছেন। বেরিয়ে এসেছেন স্ত্রী সর্বজয়া। দুর্গা মারা গিয়েছে জ্বরে কয়েক দিন আগে। কোথাও কোন উত্তর নেই। নেপথ্যে রয়েছেন সুরকার রবিশঙ্কর। আর দর্শকের চোখে অশ্রুবারি।
রবিশঙ্কর ম্যাজিক দেখাতেন। তিনি বিশ্বনাগরিক ছিলেন। কোন স্থান, কাল, পাত্রে এরকম প্রতিভাকে বর্ণনা করা যায় না। তাই ওঁর কথা বললেই মাইহার, জর্জ হ্যারিসন, গ্র্যামি, সারে জাহা সে আচ্ছা, আইপিটিএ, সু, ইয়েহুদি মেনুহিন, গান্ধী— কত কিছু চলে আসে নিজের মতো করে।
স্টেজে রবিশঙ্কর ও অন্নপূর্ণা দেবী। জীবনের শেষ পারফরম্যান্স। হলভর্তি লোক করতালি দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছেন। পর্দার মায়াবী আলো যেন নতমস্তকে অভিবাদন জানাচ্ছে।
কিন্তু এরকমটা হয়নি। জীবনের শেষ পারফরম্যান্স ৯২ বছর বয়সে নাকে অক্সিজেন নল নিয়ে, পাশে যোগ্য সঙ্গত করছেন অনুষ্কা শঙ্কর আর তবলায় পণ্ডিত তন্ময় বসু। আর অন্নপূর্ণা দেবী? তিনি পর্দার ওপারেই থেকে গিয়েছেন। বাংলার রবি কি কোনও দিন চাননি অন্নপূর্ণা দেবী পারফর্ম করুন? এটি কি চাপিয়ে সিদ্ধান্ত ছিল নাকি অন্নপূর্ণা দেবী সহমত ছিলেন? সত্যিটা কোনও দিনই আর জানা যাবে না।
বাংলার রবি তথা রবীন্দ্র শঙ্কর চৌধুরী রক্তমাংসের। তাঁদের ভুল ত্রুটিতে ইতিহাস ক্ষুণ্ণ হয় না। বেঁচে থাক ওঁর স্মৃতি, ওঁর ধ্রুপদী সঙ্গীতের শিক্ষা। অনুষ্কা শঙ্কর আর নোরা জোনসের মধ্যে দিয়ে রবি থেকে যাবেন কোনও এক লাইভ স্টেজে ,যেখানে দর্শক বারবার তাঁকে খুঁজবেন…