অস্কারের মঞ্চে বডি শেমিংয়ের অভিযোগ উঠেছে, তাই এত হইচই। শরীর, গায়ের রং নিয়ে রসিকতা ভারতের সমাজে এবং ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে স্বাভাবিক ঘটনা, মনে করেন অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র।
ডয়চে ভেলে: অস্কারের মঞ্চে ক্রিস রক যা বলেছেন, আপনি কি তা সমর্থন করেন?
শ্রীলেখা মিত্র: ক্রিস রক যা বলেছেন, তা বডি শেমিংয়ের নামান্তর। ফলে সমর্থন করার প্রশ্নই ওঠে না। একজন মানুষের অসুস্থতা কখনও রসিকতার বিষয় হতে পারে না। তবে তার প্রতিবাদে উইল স্মিথ যা করেছেন, তা-ও সমর্থনযোগ্য নয়। প্রকাশ্য মঞ্চে ওভাবে চড় মারা যায় না। মুখে কথা বলেই তিনি প্রতিবাদ জানাতে পারতেন। তবে গোটা ঘটনায় একটি বিষয় চোখে পড়ার মতো। ক্রিস রক যখন বলছেন, আর উইল স্মিথ যখন চড় মারছেন, দুই সময়েই দর্শক একইরকমভাবে হেসে যাচ্ছিলেন। এঁরা কিন্তু সকলেই বড় বড় মানুষ। তাই অস্কারের সভায় যেতে পেরেছেন। বডি শেমিং এবং তার উত্তরে সহিংসতা দুটোই তাঁদের কাছে রসিকতা। এটাই সমাজের সমস্যা।
বডি শেমিং কি তাহলে সমাজের মজ্জায় গেঁথে আছে?
অবশ্যই। মানুষের শরীর, চেহারা নিয়ে রসিকতা করা তো সমাজের আদিতম চর্চাগুলির একটি। সমাজ এসব নিয়ে মজা পায়। এগুলি যে অন্যায়, সে বোধ সমাজের নেই।
আপনি এখন বডি শেমিংয়ের বিরুদ্ধে এত কথা বলছেন, কিন্তু আপনিও কি এধরনের বিষয়কে উসকে দেননি?মিরাক্কেল নামে একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে আপনি তো নিয়মিত জাজ হিসেবে বসতেন! সেখানে তো এ ধরনের রসিকতা অনেক হত!
প্রথমত,আমি আর ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিই না। দ্বিতীয়ত, একটি কথা বলে নেওয়া ভালো। টেলিভিশন শোয়ে সব নিজের হাতে থাকে না। বরাবর সেক্সিস্ট এবং বডি শেমিং জাতীয় রসিকতার বিরোধিতা করেছি। খুব কড়া ভাষায় প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু টেলিকাস্টের সময় দেখেছি,ওই অংশগুলি কেটে দেওয়া হয়েছে। টিআরপি-র জন্য টেলিভিশন সব করতে পারে। বডি শেমিং নিয়ে তাদের বিশেষ মাথাব্যথা নেই। একটা কথা এখানে স্পষ্ট করে বলতে চাই,সেক্সুয়াল বা যৌনতা বিষয়ক জোক নিয়ে আমার কিন্তু কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু সেক্সিস্ট অথবা বডি শেমিং জাতীয় জোক নিয়ে আছে। যে জোক অন্যকে দুঃখ দেয়,কষ্ট দেয়, তা কখনও সত্যিকারের রসিকতা হতে পারে না।
বেশ কয়েকবছর আগে বডি শেমিং বিষয়টি নিয়ে উত্তাল হয়েছিল কলকাতা। মীরের সঙ্গে ঋতুপর্ণ ঘোষের বিতর্ক সাড়া ফেলে দিয়েছিল। আপনি কীভাবে দেখেন বিষয়টি?
যারা স্ট্যান্ড আপ কমেডি করেন,কিংবা মিমিক করেন,সমাজ থেকেই তাঁদের রসদ জোগাড় করে নিতে হয়। মীর ঋতুপর্ণের কথা বলা নকল করেছিল বা সেটা নিয়ে মিমিক করেছিল। ঋতুপর্ণের বক্তব্য ছিল,মীর অত্যন্ত চটুল মিমিক করতে গিয়ে ট্রান্সজেন্ডারদের আঘাত করছেন এবং একটি কমিউনিটিকে অসম্মান করছেন। আমার মনে হয়, সমাজ থেকে রসদ নেওয়া এবং সেটাকে রসিকতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মাঝখানে একটি খুব সূক্ষ্ণ লাইন থাকে। সেই লাইন পেরিয়ে গেলে সেটা বডিশেমিং বা কমিউনিটি শেমিংয়ের জায়গায় চলে যায়। সেক্সিস্ট হয়ে যায়। ঋতুপর্ণ সম্ভবত সে কথাটিই বলতে চেয়েছিলেন।
আপনাকেও তো বডি শেমিংয়ের শিকার হতে হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিতে।
একবার নয়,একাধিকবার। কিছুদিন আগে রিমঝিম মিত্র আমাকে ‘থলথলে বৌদি’ বলে বাজার গরম করেছিলেন। আমি তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম। মিডিয়া কিন্তু তখন আজকের মতো প্রতিবাদ করেনি। তারা আমাদের বিতর্ক বিক্রি করে টিআরপি তুলছিল। একবারও তখন মিডিয়ার মনে হয়নি,বডি শেমিং নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা করা দরকার।
ভারতের বিজ্ঞাপন,সিনেমা, সিরিয়াল,সিরিজ সবের মধ্যেই কি বডি শেমিং,সেক্সিস্ট বিষয়গুলি কোথাও গেঁথে থাকে বলে মনে হয়?
থাকে তো! ভিলেনের গায়ের রং কখনও ফর্সা দেখেছেন? নির্বোধ বোঝানোর জন্য মোটা মানুষকে কাস্ট করা হয়। খারাপ মনের নারী মানেই তাকে সিগারেট খেতে হবে, মদ খেতে হবে,শরীর দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে সে খারাপ। কিন্তু হিরো মদ খেলে কিন্তু তাতে দোষ নেই। এমনকী,ছোটদের ছবিগুলিতেও এমন জিনিস দেখা যায়। দুষ্টু বাচ্চা মানেই সে কালো। হাবাগোবা বাচ্চা মানেই সে মোটা,লেথারজিক। বলছি না, মজ্জায় ঢুকে আছে এসব। আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি-অর্থনীতি-রাজনীতি সবকিছুর মধ্যে এসব ঢুকে বসে আছে।
রাজনীতিতেও?
নিশ্চয়। খেয়াল করবেন,কোনও নারী রাজনীতিবিদের বিরোধিতা করতে হলেই তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার একটি অদ্ভুত প্রবণতা আছে। আমি নিজে রাজনীতিমনস্ক। তার জন্য আমায় চরিত্র,শরীরের গঠন নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে। পুরুষদের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্যি। বহু রাজনীতিকের শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে রসিকতা করা হয়। আসলে সমাজ এগুলোই ‘খায়’। পপুলিস্ট হতে হলে সমাজের কাছে এসব বেচা সহজ। সে কারণেই দিনে দিনে এসব আরও বাড়ছে।