চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে ডিমেনশিয়ার ওপর একটি রিপোর্ট পেশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী ৫.৫ কোটি ব্যক্তি ডিমেনশিয়ার শিকার। এমনকি প্রতি ৩ সেকেন্ডে একটি নতুন কেস সামনে আসছে। মৃত্যুর অন্যান্য সমস্ত কারণের মধ্যে ডিমেনশিয়া সপ্তম স্থান অধিকার করে। আবার এর ফলে বয়স্ক ব্যক্তিরা হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভরশীল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ডিমেনশিয়ার প্রাথমিক লক্ষণ সম্পর্কে সচেতনা খুবই কম। ২০৩০ সালের মধ্যে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা পৌঁছে যেতে পারে ৭.৮ কোটিতে। ভুলে যাওয়া, বিভ্রান্তি এবং ব্যবহারে পরিবর্তনকে বার্ধক্যজনিত সাধারণ সমস্যা ভেবে অনেকে উপেক্ষা করে যান, যার ফলে সঠিক রোগ নির্ণয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বিলম্ব হয়।
কোনও বয়স্ক ব্যক্তির ব্যবহার যখন পরিবারের জন্য লজ্জাজনক বা চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে, তখন সকলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। অ্যালজাইমার্স অ্যান্ড রিলেটেড ডিসঅর্ডার্স সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, খুব স্বল্প সংখ্যক ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি পরিবারের সহযোগিতা লাভ করছেন। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই তা হয় না।
ডিমেনশিয়া রোগ নির্ণয় ও যত্নের পথে প্রতিবন্ধকতা
ডিমেনশিয়া একটি সিন্ড্রোম বা লক্ষণের সমষ্টি। যা মস্তিষ্কের রোগ বা আঘাত লাগার ফলে ঘটে থাকে, এটি বার্ধক্যের কোনও স্বাভাবিক অংশ নয়। এর সাধারণ লক্ষণগুলি হল—
১. জ্ঞানীয় ক্ষমতার অবনতি। স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যাওয়া, ভাষা বুঝতে ও ব্যক্ত করতে সমস্যা হওয়া, পারিবারিক কাজের পরিকল্পনা করতে ও সেই কাজ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়া, মনোযোগহীনতা এবং বিচারের ক্ষমতা হারানো।
২. মেজাজ ও ব্যবহারে পরিবর্তনও অতি সাধারণ।
ডিমেনশিয়ার প্রাথমিক স্তরে ব্যক্তি কাজকর্ম এবং সামাজিক ক্রিয়াকলাপ থেকে দূরত্ব সৃষ্টি করে নেয়। যে ব্যক্তি এই কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন, তাঁদের পক্ষে এটি মেনে নেওয়াও অনেক সময় লজ্জাজনক হয়ে পড়ে। পরিবার ও বন্ধুর কাছ থেকে নিজের মানসিক পরিস্থিতি লুকিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, যার ফলে ডিমেনশিয়ার প্রাথমিক লক্ষণগুলি কেউ নজর করতে পারে না।
দুর্ভাগ্যবশত ৩০ বছরের গবেষণার পরও ডিমেনশিয়ার কোনও চিকিৎসা চিহ্নিত করা যায়নি। ফলে মস্তিষ্কের ডিজেনারেশনের কারণে ডিমেনশিয়া আক্রান্তরা নিজের দৈনন্দিন কার্যকলাপের জন্য পরিবারের সদস্যদের ওপর সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ডিমেনশিয়া কেয়ার ফেসিলিটির অভাবে, এই রোগীদের দেখাশোনার সমস্ত দায়িত্ব গিয়ে পড়ে পরিবারের সদস্যদের ওপর।
প্রাথমিক পর্যায় রোগ নির্ণয়ের গুরুত্ব
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, ডিমেনশিয়া রোগ নির্ণয়ের পর ব্যক্তি প্রায় ১০ বছর জীবিত থাকে। তবে জীবিত থাকার এই সময়সীমা ৫ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। ডিমেনশিয়া সারিয়ে তোলার কোনও চিকিৎসা না-থাকলেও ত্রিমুখী পন্থা অবলম্বন করে এর লক্ষণগুলিকে কমানো যায়। ব্যবহারিক পন্থা অবলম্বন করে তাঁদের চ্যালেঞ্জিং ব্যবহারকে ম্যানেজ করা যায়। আবার পারিবারিক কেয়ারগিভারদের জন্য মানসিক ও সামাজিক সমর্থনের সাহায্যে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উন্নতি দেখা গিয়েছে।
তবে প্রাথমিক পর্যায় এই রোগ নির্ণয় কঠিন। চিকিৎসা ব্যবস্থা ও মনস্তাত্ত্বিক সহযোগিতার সুবিধা গ্রহণ করে এবং সঠিক সময় এই রোগ নির্ণয় সম্ভব হলে পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘকলীন যত্ন গ্রহণের পরিকল্পনা করতে পারেন, যার ফলে ওই ব্যক্তির জীবন আরও ১-২ বছর বেড়ে যেতে পারে। আগে থেকে জানা থাকলে, আত্মীয়রা ওই ব্যক্তির দেখাশোনা, চিকিৎসা-সহ নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এমনকি খরচের বিষয়েও পরিকল্পনা করে রাখতে পারবেন।
তবে ডিমেনশিয়ার চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয় সাপেক্ষ। অ্যালজাইমার্স ডিসিস ইন্টারন্যাশনালের একটি এস্টিমেট থেকে জনা যায় যে ডিমেনশিয়ার গ্লোবাল ইকোনমিক কস্ট হল ৮১৮ বিলিয়ন। অর্থাৎ ডিমেনশিয়া যদি কোনও দেশ হত, তা হলে বিশ্বের অষ্টাদশতম সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হত ডিমেনশিয়া। চিকিৎসার খরচ, হাসপাতালে ভরতি করা, যত্ন প্রদানের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়। রোগের গুরুতর পরিস্থিতি বিচারে ভারতে এই খরচ গিয়ে দাঁড়াতে পারে লক্ষ টাকায়। আবার সহজলভ্য ও সুলভ ব্যবস্থার অভাবে কর্মরত মহিলাদের পক্ষে চাকরি ছেড়ে ২৪ ঘণ্টা ডিমেনশিয়া রোগীকে যত্ন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
সেপ্টেম্বর হল বিশ্ব ডিমেনশিয়া সচেতনতা মাস। এ মাসে বিশ্বব্যাপী সংস্থাগুলি প্রাথমিক রোগ নির্ণয়ের প্রতি প্রয়োজনীয় সচেতনতা প্রসার করছে। আগামী দশ বছরের মধ্যে ভারতে ৭ কোটি ৬০ লক্ষ ব্যক্তি ডিমেনশিয়া আক্রান্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই প্রাথমিক পর্যায় রোগ নির্ণয় অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। সাধারণ মনস্তাত্ত্বিক এবং ক্লিনক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে স্বল্প খরচে এই রোগ সম্পর্কে জানা যায়। দুর্ভাগ্যবশত ভারতে মেমোরি স্ক্রিনিং ক্লিনিকের সংখ্যা অত্যন্তই হাতে গোণা।
সারা বিশ্বে যখন ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা উত্তোরত্তোর বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন এই ধারণাকে নিজের মন-মস্তিষ্ক থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে যে, ডিমেনশিয়া বার্ধক্যের সাধারণ লক্ষণ। তাই শীঘ্র রোগ নির্ণয়ের ওপর জোর দিতে হবে, যাতে পরিবারের সদস্যরা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে রাখতে পারে। জেনে রাখুন, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের এটিই সঠিক সময়।