গত দশ বছরেও বাঙালি সংস্কৃতিতে ধনতেরাসের ছোঁয়া লাগেনি। কিন্তু মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাবে এবং বিজ্ঞাপনের যুগে ধনতেরাস ঢুকে পড়েছে বাঙালির ঘরে ঘরে। কিন্তু এই ধনতেরাস কাকে বলে? কেনই বা পালন করা হয়?
ইতিহাসের পাতা খুঁজে জানা যায় ধনসম্পত্তির দেবতা হলেন কুবের। লক্ষ্মী দেবী মুনি দুর্বাসার অভিশাপে সর্বচ্যুত হয়ে সাগরে বাস করা শুরু করেন। সমুদ্র মন্থনে লক্ষ্মী দেবী ফিরে আসেন. অনেকের মতে রাজা হিমের পুত্রের অভিশাপ ছিল যে বিবাহের চতুর্থ রাতে সর্পদংশনে মারা যাবেন। আর তখন সদ্য বিবাহিতা নিজের স্বামীর প্রাণ বাঁচানোর আশায় দরজায় সাজিয়ে রাখেন নিজের সোনার গয়না।সারা ঘরে জ্বালিয়ে দেয় বাতি। স্বামীকে জাগিয়ে রাখতে গল্প-গান শোনায়। যমরাজ প্রবেশ করতে গেলেও সেই সোনার চমকে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সেই গল্প আর গান শুনেই তাঁর সময় কেটে যায়। নিজের উদ্দেশ্য সফল করার কথা ভুলে যান, ফলে রাজপুত্রের প্রাণ বেঁচে যায়। আর এই আনন্দেই পরের দিন উদযাপন হয় ধনসম্পদের আরাধনা অর্থাত্ ধনতেরাস।
পুরাণ মতে, সমুদ্রের ক্ষীরসাগর থেকে উঠে এসেছিলেন মহালক্ষ্মী। অমাবস্যার অন্ধকার থাকায়, লক্ষ্মীকে বরণ করে স্বর্গে ফিরিয়ে নেওয়ার অনুষ্ঠানে আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয় স্বর্গকে।মা কালী অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটান আর মা লক্ষ্মী ঘটান শ্রী বৃদ্ধি। অপর এক কাহিনী অনুসারে
ধনতেরাসের দিন সমুদ্র মন্থন থেকে অমৃত কলস নিয়ে ধন্বন্তরী আবির্ভূত হন। সমুদ্র মন্থনের ফলে ১৪টি রত্নের উৎপত্তি হয়। এই দিন দেবী লক্ষ্মী, গণেশ এবং কুবেরের পুজো করা হয়।
ধন্বন্তরি কে বৈদ্য, বনস্পতি এবং ওষুধের অধিপতি নিযুক্ত করেছিলেন বিষ্ণু। ধন্বন্তরীর আশীর্বাদে সমস্ত রোগের বিনাশ হয়ে যেত। সমুদ্র মন্থনের সময় শরৎ পূর্ণিমার চাঁদ, কার্তিক দ্বাদশীর দিনে কামধেনু, ত্রয়ো দশের দিনে ধন্বন্তরি এবং অমাবস্যার দিনে মহালক্ষ্মীর উৎপত্তি হয়েছিল। মানুষের কল্যাণী ধন্বন্তরি ছিলেন যিনি প্রথম অমৃতময় ওষুধের খোঁজ দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: (কেন ধনতেরাসে পালিত হয় আয়ুর্বেদ দিবস! জানুন কারণ এবং গুরুত্ব)
আরও পড়ুন: (কালীপুজো মানেই আতশবাজি! কোথা থেকে এলো এই সংস্কৃতি? জানেন?)
ধন্বন্তরীর বংশে জন্ম নেন চিকিৎসার জনক দিবদাস। মহর্ষি বিশ্বামিত্রের পুত্র সুশ্রুত ছিলেন দিবদাসের শিষ্য। সুশ্রুত আয়ুর্বেদের অন্যতম গ্রন্থ সুশ্রুত সংহিতা রচনা করেছিলেন। পৌরাণিক ধারণা অনুযায়ী, ধনতেরাসের দিন সমস্ত বিধি নিষেধ মেনে যদি পূজো করা হয় তাহলে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
পুরান মতে, ধনতেরাসের দিন বিষ্ণু মর্ত্যে বিচরণ করতে আসেন এবং তার সঙ্গ নেন লক্ষ্মী। মর্ত্যে এসে বিষ্ণু লক্ষীকে একটি স্থানে অপেক্ষা করতে বলেন। যাওয়ার সময় তিনি বলে যান, তিনি দক্ষিণ দিকে যাচ্ছেন এবং তিনি যতক্ষণ না ফিরে আসছেন ততক্ষণ লক্ষ্মী যেন কোথাও না যান। কিন্তু লক্ষ্মী বিষ্ণুর কথা না মেনে বিষ্ণুর পিছু নেন।
বিষ্ণুর পিছু নিয়ে কিছুক্ষণ এগুনের পর সর্ষের ফুল দেখতে পেয়ে সেখানে সাজতে বসেন লক্ষ্মী। আবার কিছুক্ষণ যাওয়ার পর আখের ক্ষেত থেকে আখ তুলে খান তিনি। এরপর বিষ্নু সেখানে আসেন এবং লক্ষ্মী দেবীকে দেখে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে যান। ক্ষুব্ধ বিষ্নু লক্ষ্মীকে অভিশাপ দেন, যাতে লক্ষী ১২ বছর কৃষকদের সেবা করেন।
লক্ষ্মীকে অভিশাপ দেওয়ার পর বিষ্ণু চলে যান ক্ষীরসাগরের উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে কৃষকের ঘরে ১২ বছর কেটে যায়, লক্ষীর। ১২ বছর পর বিষ্ণু লক্ষীকে নিতে এলে কৃষকের স্ত্রী তাকে যেতে দেন না। তখন বিষ্ণু জানান, লক্ষ্মীকে কেউ যেতে দিতে চায় না কিন্তু লক্ষ্মী চঞ্চলা কোথাও থাকে না। তখন লক্ষী ওই কৃষককে জানান, তার কথা মতো যদি ওই কৃষক চলতে পারেন তাহলে কোনদিন লক্ষীর অভাব হবে না তার ঘরে।
লক্ষ্মী বলেন, ধনতেরাসের দিন ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে রাতে ঘি এর প্রদীপ জ্বালিয়ে সন্ধ্যেবেলা যদি পুজো করতে পারেন ওই কৃষক, তাহলে লক্ষ্মী সারা জীবনের জন্য থেকে যাবেন তার বাড়িতে। একটি রুপোর ঘটে তার জন্য টাকা ভরে নিয়ে আসতে বলেন লক্ষী। ওই ঘটেই চিরকালের জন্য ওই কৃষকের বাড়িতে থেকে যান মা লক্ষ্মী। তারপর থেকেই ধনতেরসের দিন ঘর বাড়ি পরিষ্কার করে মা লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়।