জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ সম্প্রীতির সঙ্গে সহাবস্থান করে ভারতে। ভারত এমন একটি দেশ, যেখানে একই সঙ্গে আপনি দেখতে পাবেন একাধিক ধর্ম বর্ণ এবং জাতির মানুষদের। তবে এই ভিন্ন ধর্মের মানুষেরা নিজ গুণে পরিচিত। কিন্তু ভারতের বুকে এমন একজন মানুষ রয়েছেন, যার বেশভূষা তো বটেই, ঈশ্বর সাধনাও আপনাকে করে তুলবে বিস্মিত। জন্মগতভাবে তিনি মুসলমান হলেও তিনি একজন একনিষ্ঠ জগন্নাথ ভক্ত। তবে শুধু ভক্ত বললে ভুল বলা হবে, প্রভু জগন্নাথ দেবকে নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেছেন কলকাতার সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল মিশন কলেজের বাংলার অধ্যাপক ডঃ শেখ মকবুল ইসলাম।
তবে ডক্টর শেখ মকবুল ইসলাম প্রথম নন, আজ থেকে বহু বছর আগে এমন আরও একজন ভক্তের দেখা পেয়েছিল গোটা ভারত। আজ থেকে বহু বছর আগে জগন্নাথ দেবের মুসলিম ভক্ত শালবেগকে যখন পুরীর মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না, তখন মনের দুঃখে শালবেগ প্রভু জগন্নাথ দেবকে বলেন, 'হে প্রভু, আমি এতদূর থেকে আপনার কাছে এলাম আপনার দর্শন করব বলে কিন্তু আমি পারলাম না আপনাকে দেখতে।' শালবেগের এই কষ্ট লাঘব তখন হয় যখন স্বয়ং প্রভু জগন্নাথ দেব তাঁর ভক্তের স্বপ্নে এসে তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, প্রতি বছর রথযাত্রা উৎসবের সময় মাসির বাড়ি যাওয়ার পথে তিনি নিজে শালবেগের সঙ্গে দেখা করে যাবেন। ভক্ত প্রভুর কাছে পৌঁছতে পারেনি তো কি হয়েছে, প্রভু নিজে আসবেন ভক্তের সঙ্গে দেখা করতে। তারপর থেকে প্রতি বছর রথের সময় মাসির বাড়ি যাওয়ার সময় ভক্ত শালবেগের দ্বারে কিছুক্ষণ দাঁড় করানো হয় তবু জগন্নাথ দেবের রথ।
(আরও পড়ুন: অস্বাস্থ্যকর খাবার নিষিদ্ধ, কলেজে আর পিৎজা-বার্গার পাওয়া যাবে না! কী নির্দেশ কমিশনের)
কলিকালে শালবেগের সেই গল্পেরই বাস্তব রূপ যেন দেখা যায় ডক্টর মকবুলের মধ্যে। হিন্দু-মুসলিম সব ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে তাঁর ঈশ্বর সাধনাই যেন শেষ কথা বলে। সম্প্রীতির জল জ্যান্ত নিদর্শন হলেন তিনি। গত ৩৫ বছরে প্রভু জগন্নাথ দেবের টানে তিনি ঘুরেছেন ভারতের বিভিন্ন স্থানে। ঘুরেছেন শ্রীলংকা থেকে শুরু করে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত। লিখেছেন জগন্নাথ মঙ্গল, জগৎ মঙ্গল, নামক একাধিক বই। ১৩ জন মানুষের লেখা ১৩টি গবেষণা প্রবন্ধের সংকলন শ্রী জগন্নাথ, চর্চায় এবং চিন্তনে বইটির সম্পাদকও তিনি।
মকবুল ইসলামের কথায়, 'সকলে বলেন, পুরীর মন্দিরে অন্য ধর্মের মানুষ প্রবেশ করতে পারেন না। কিন্তু হয়তো অনেকেই জানেন না, এই নোটিশ ঝুলিয়েছিল ইংরেজরা। সেই নোটিশ এখনও রয়েছে। পুরীর মন্দির কর্তৃপক্ষ আলাদা কোনও নোটিশ তৈরি করেনি। ভালো করে দেখলে বুঝতে পারবেন, নোটিশে লেখা রয়েছে হিন্দুরাই মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে। কিন্তু কোথাও লেখা নেই, অন্য ধর্মের লোকেরা প্রবেশ করতে পারবেন না।'
তিনি আরও বলেন, ‘প্রভু জগন্নাথ দেবকে ওড়িষার বাইরে সারা ভারতে প্রথম প্রচার করেছিলেন প্রভু শ্রী চৈতন্যদেব। তবে সারা বিশ্বে জগন্নাথের প্রচার করেছিলেন ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী লঘুপাদ। শুধু তাই নয়, জগন্নাথ দেবের প্রচারের ক্ষেত্রে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ এবং মা সারদা দেবীরও অবদান কম নয়।’
(আরও পড়ুন: অস্বাস্থ্যকর খাবার নিষিদ্ধ, কলেজে আর পিৎজা-বার্গার পাওয়া যাবে না! কী নির্দেশ কমিশনের)
শুধু জগন্নাথ দেব নয়,হিন্দু ধর্ম এবং সাহিত্য নিয়েও অগাধ জ্ঞান তাঁর। তিনি বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে প্রভু জগন্নাথ দেবকে নিয়ে তেমন কিছুই লেখা নেই, যে দুটি জগন্নাথ মঙ্গল কাব্য লেখা রয়েছে, সেগুলি তুলনামূলক আলোচনা মাত্র।’ তাঁর লেখা Shri Jagannath Hinduism, literacy cultural discourse নামক বইটি তিনি উৎসর্গ করেন পুরীর শংকরাচার্য স্বামী নিশ্চলানন্দ সরস্বতীকে, যিনি ২০১৫ সালে নব কলেবর পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন শেখ মকবুল ইসলামের হাতে। এই পুরস্কারটি জগন্নাথ গবেষণার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত করা হয়।
প্রসঙ্গত, আজও রথের দিন ছোটদের নিমন্ত্রণ করেন শেখ মকবুল। রথে করে নয়, প্রভু জগন্নাথ দেবকে কোলে করে এলাকা পরিক্রমা করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘রথ বড়দের নয়, বড়দের ছোট হওয়ার উৎসব।’ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছোট ছোট শিশুরা যেন রথযাত্রার উৎসব পালন করতে পারে, এই আশাতেই বুক বাঁধেন কলিকালের ভক্ত শালবেগ ওরফে শেখ মকবুল ইসলাম।