Durga Puja 2024: রাত গভীর। কিন্তু পাঠাভ্যাস থামেনি। পাঠাভ্যাস মানে সবসময় গুরুর কাছে বসে শিক্ষাগ্রহণ, তা নয়। বরং নিজের ভিতর ভিতর চর্চা। সেই চর্চাই করে চলেছেন বাক্। ঋষি অম্ভ্রিনের এই কন্যা শিক্ষাদীক্ষায় দিন দিন বিদূষী হয়ে উঠছেন। ঋষিতুল্য গুণে সঞ্জাত হচ্ছে তাঁর অন্তর ও মস্তিষ্ক। আর তাঁর বাকশক্তি ঋদ্ধ করছে জীবন ও জন্মের কাঠামো। সভ্যতা ও জন্ম-প্রযুক্তির কোনও অংশই নারী ব্যতীত নির্মাণ করা যায় না। ঋষিকন্যা বাকের ভিতর ভিতর সেই নারীর আলোই যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এবার যেন তাঁর প্রকাশের সময়। তাঁর নারীত্বে মিশেছে বিদ্যার অম্লান আলো। নারীত্ব ও আলো মিলে শব্দের ফলায় ধার দিচ্ছে। ধীরে ধীরে যে বর্ণস্রোত বেরিয়ে আসছে বাকের কণ্ঠ দিয়ে, তার দ্যুতি চমকে দিচ্ছে অতীত ও ভবিষ্যতকে। মনে করিয়ে দিচ্ছে অচেতনকে — নারী অদম্য। এই বর্ণস্রোত এক দেবীর আত্মপরিচয়। তাঁর মধ্যে দিয়ে গোটা জগতের প্রকাশনা। বাক্ সেদিন রচনা করেছিলেন —
অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহম্
আদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহম্
ইন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোভা ।। ১
অর্থাৎ ‘আমি একাদশ রুদ্র, অষ্ট বসু, দ্বাদশ আদিত্য এবং বিশ্ব দেবতারূপে বিচরণ করছি। আমি মিত্র ও বরুণ উভয়কেই ধারণ করে রয়েছি। আমি ইন্দ্র, অগ্নি এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে ধারণ করে রয়েছি।’
এখানে ‘আমি’ কোনও নারীর আত্মগৌরব রচনা করে না। এই ‘আমি’ নয় কোনও শব্দতেজ বা আমিত্বের আস্ফালন। বরং এই আমি আদি থেকে আধুনিক পৃথিবীর সমগ্র সময়কালের বাস্তব। আমিকে দমন করে এত যুদ্ধ, রক্ত, বিদ্রোহ ও বিপ্লবের ধ্বংসপ্লাবন — সবটাই বৃথা। আমিকে নিয়েই বরং আমাদের প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকা। কী সুখ, কী ছায়া, কী বন্যায়।
আরও পড়ুন - Durga Puja 2024: জোটেনি পেনশন, আকাশবাণী থেকে যোগ্য সম্মানটুকুও পাননি ‘স্টাফ’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম অনুবাকের ১২৫ তম সূক্ত ‘অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহম্…’। মোট আটটি শ্লোক নিয়ে রচিত ঋষিকন্যা বাকের এই মন্ত্র দেবীসূক্ত নামে পরিচিত। চণ্ডীপাঠের পরে এই বিশেষ সূক্ত পাঠের রীতি। যে সময় এই সূক্তটি লেখা হয়েছিল, তখন এই একুশ শতক কালের গর্ভে। হয়তো শুধু আলো জ্বালানো ও জীবনধারণের প্রাথমিক ধাপ শিখেছিল মানুষ। সেই আলোতেই বাক রচনা করেছিলেন এক দেবীর আত্মপরিচয়। তখন সেই আলোর চারপাশে অন্ধকার। আজ একুশ শতকের ফ্লাড লাইটের চারপাশেও অন্ধকার জমাট বেঁধে। কোন অন্ধকার বেশি, কে মাপবে ? তবে সত্য এটাই — অন্ধকার ছিল। তার মধ্যেই অল্প আলোয় জন্ম নিয়েছিল দেবীর আত্মপরিচয়। বিদ্যার আলো অম্লান বলেই আজও সেই মন্ত্রে দেবী তাঁর আত্মপরিচয় ঘোষণা করেন। ঘোষণা করে প্রতিটি নারী। এই সত্য ব্যতীত দ্বিতীয় বাস্তব কোথায় ?
দেবী শুধু তো নারী নন। জীবের বাইরে তথাকথিত জড়ত্বেও তাঁর প্রকাশ। তিনিই প্রকৃতি। হঠাৎ জল, হঠাৎ রোদে চারপাশ উত্তাল। হঠাৎ বন্যা, হঠাৎ ধস, খবরের কাগজের পাতা ভরাট করে এলেও আসেনি এক সভ্যতার মনে। মন কি অচেতন ? শুনেও সে কি শুনতে পায়নি সাবধানবাণী ? বড় খাদের ঠিক ধার দিয়ে তার পথচলা। যে কোনও মুহূর্তেই বুজতে হতে পারে চোখ । দেবীর অবমাননা শুধু নারীর অবমাননা নয়। বরং আরও ব্যাপক আকারে তা জন্মের বিবিধ উপকরণের অবমাননা। অবমাননা এই নিষ্পাপ আলো, হাওয়া ও জলের। যাদের অসুখ হলে সভ্যতার সংক্রমণ হয়। সংক্রমণ থেকে মৃত্যু হতে কয়েক মুহূর্তই যথেষ্ট!
আরও পড়ুন - Durga Puja 2024: চণ্ডীপাঠে ডাহা ফেল করেন মহানায়ক! বেতার অফিস ভাঙচুরের পর কী হয়েছিল সেই মহালয়ায় ?
নারীতেই জন্ম — জগত ও জীবনের এই অকৃত্রিম সত্য মনে করিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। বরং মনে করিয়ে দেওয়ার বিষয় এই যে, নারীর অবমাননায় মৃত্যু অবধারিত। মৃত্যু জগতের, মৃত্যু সকল প্রাণের। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য 'রক্তকরবী'র একটি অংশ ইদানীংকালে বেশ পরিচিত হয়েছে সকলের কাছে। সেখানে রাজাকে নন্দিনী বলেছে - ‘আমার অস্ত্র নেই। আমার অস্ত্র মৃত্যু।’ নারীর মৃত্যু মানে একে একে সবকটা জন্মপথ বন্ধ হয়ে যাওয়া। শেষ জন্মপথ বন্ধ হওয়ার পর মৃত্যু হত্যাকারীকেই গ্রাস করে। এই সভ্যতা কি সেই জন্মপথ রোধ করার আত্মনিধন যজ্ঞে মেতেছে?
‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক-মঞ্জীর।’ ঠিক তারপরেই অবশ্যসম্ভাবী ঋষিকন্যা রচিত দেবীর আত্মপরিচয়। প্রতি বছর মহালয়ার বিশেষ অনুষ্ঠান মহিষাসুরমর্দিনীর এই নিয়ম। এই নিয়ম জীবনেরও। প্রতি ভোরে আলোক-মঞ্জীর বেজে ওঠার পর তাঁর আত্মপরিচয়ই সভ্যতার প্রকাশপথ হয়ে দাঁড়ায়। ঋষিকন্যার মন্ত্র বারবার মনে করিয়ে দেয় সেই ‘আমি’র কথা। এই ‘আমি’কে সভ্যতা জেনে বা না জেনে তাঁর রক্তমাংসে বহন করে চলেছে। উৎসবের উদযাপন তো আসলে এই সত্যটুকুর উদযাপন। ‘আমি’ নামক যে নারী নিরন্তর সভ্যতাকে লালন করে চলেছে, এই উদযাপন আসলে তাঁর উপস্থিতির। এই উৎসব পক্ষ ছাড়িয়ে যাক। ছড়িয়ে পড়ুক যুগে যুগে, প্রতি মুহূর্তে ও তাবৎ কালজুড়ে।