HT Bangla Special: সাম্প্রতিককালে প্রায় নিঃশব্দে নাম বদলে গেল ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের। গত বছর ডিসেম্বর নাগাদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নির্মিত ২৫০ বছর পুরনো দুর্গটির নাম বদলে রাখা হয়েছে ‘বিজয়’ দুর্গ। আরব সাগরের তীরে মহারাষ্ট্রের এক প্রাচীন স্থান, যার ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে মারাঠা সাম্রাজ্যের ইতিহাস, তার নামেই নামকরণ। প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্তাদের কথায়, ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাসকে মুছে ফেলাই উদ্দেশ্য। কিন্তু ইংরেজ শোষণের ইতিহাস মুছতে গিয়ে অন্য এক শোষণের ইতিহাস মনে করিয়ে দিল না তো এই নাম? HT বাংলার সঙ্গে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করলেন ইতিহাসবিদ কিংশুক চট্টোপাধ্যায়।
এক অত্যাচার ভুলতে অন্য অত্যাচার?
‘বাংলায় বর্গি আক্রমণের ভয়াবহ ইতিহাস এখনও মা-ঠাকুমাদের মুখের ছড়া দগদগে স্মৃতির মতো বয়ে বেড়ায়। সেই বর্গি তো আদতে মারাঠারাই। তাদের দীর্ঘ দুই দশকের শোষণ, অত্যাচার অন্যান্য শাসকদের শোষণের ইতিহাসের মতোই অমলিন। ‘বিজয়’ দুর্গ নামকরণ পুরনো ইতিহাসকে ভুলতে অন্য এক শোষণের ইতিহাস চাপিয়ে দেয় বাংলার উপর।’
আরও পড়ুন - মধ্যমগ্রামে ৩০ কোটির নয়া ইকো পার্ক! কী কী চমক থাকবে? HT বাংলাকে বললেন পুরপ্রধান
‘বর্গি এল দেশে’
‘অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে বাংলার তৎকালীন চিত্র কিছুটা তুলে ধরা যাক। মুঘল আমলে গোটা দেশে তখন রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সেই স্থিতাবস্থায় ভাঙন ধরতে শুরু করল। মুঘলদের বিরোধী শক্তি হিসেবে নতুন যেসব শক্তি উঠে আসতে শুরু করল, তার মধ্যে অন্যতম মারাঠা। মারাঠারা তাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য বরাবরই ‘চৌথ’ নামের কর চাপাত। যে অঞ্চলে এই কর চাপানো হবে, সেখানে উৎপাদিত ফসল তারা এক-চতুর্থাংশ নিয়ে যাবে। বিনিময়ে তারা সেই অঞ্চলে কোনও লুঠতরাজ চালাবে না। এইভাবেই রাজস্ব ব্যবস্থা আরোপিত হত। একে নিছক লুন্ঠন বলা যায় না। মারাঠাদের আধিপত্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে বাংলায়।’

মারাঠাজাতি হিন্দুদের গৌরব?
‘মুর্শিদকুলি খাঁর রাজত্বের অবসানের পর ক্ষমতায় এলেন আলিবার্দি খাঁ। বাংলার টালমাটাল রাজনৈতিক অবস্থার অবসান হল। আলিবার্দি খাঁ অত্যন্ত সুচারভাবে মারাঠা আক্রমণ প্রতিহত করেন। ১৭৪৩ সালে মারাঠা আক্রমণের প্রধান নেতা ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর শেষমেশ ১৭৫১ সালে বাংলায় মারাঠা আক্রমণ বন্ধ করতে সমর্থ হন। তবে বন্ধ হওয়ার আরেকটি কারণও উল্লেখ করা জরুরি। মারাঠা যেখানে যেখানে তারা আধিপত্য বিস্তার করতে পারত না, সেখানে বৃথা সমরশক্তি ব্যয় করত না। বাংলায় বিফল হয়ে সে সময় তারা এগিয়ে যায় উত্তর ভারতের দিকে। সারা দেশ তখন মারাঠা নামে কম্পমান। তাদের ঠেকাতে উত্তর ভারত জুড়ে একাধিক ক্ষমতা সংগঠিত হয়। নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন আহমেদ শাহ আবদালি। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠারা সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হয়। ১৭৬১ সাল তখন। আজ মারাঠা জাতিকে হিন্দুদের গৌরব হিসেবে তুলে ধরার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কিন্তু মারাঠা আক্রমণ যেখানে যেখানে হয়েছে, সেসব জায়গায় হিন্দু, মুসলমান সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে এই নামকরণকে হিন্দুত্বের বিজয়-নিশান হিসেবে দেখাও অনেকাংশে অনৈতিহাসিক।’
আরও পড়ুন - দরদর করে জলের মতো ঘাম ঝরে? ভিজে যায় জামা? হাইপারহাইড্রোসিস নিয়ে টিপস চিকিৎসকের
ইতিহাস বিকৃত করা সহজ
‘নামকরণের মধ্যে দিয়ে ইতিহাস বিকৃত করা বা মুছে ফেলার এই প্রবণতা কতটা সঙ্গত ও সার্থক শেষমেশ? এই মৌলিক প্রশ্নের দিকে এবার তাকানো যাক। ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস দীর্ঘ। প্রশাসনের উপরতলার আধিকারিকদের যুক্তি, সেই ছাপ মুছে ফেলতেই নাম বদল করা হয়েছে। কলকাতা ও কলকাতার সংস্কৃতিজুড়ে ঔপনিবেশিকতার এক মস্ত প্রভাব রয়েছে। তাহলে কি কলকাতার নামও পাল্টে দেওয়া প্রয়োজন এবার? শুধু নাম বদলালেই কি শহরের চরিত্র ও ইতিহাস বদলে ফেলা যায়? ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ বর্তমানে ভারতীয় সেনাদের ইন্টার্ন কম্যান্ড হেডকোয়ার্টার হিসেবে পরিচিত। কলকাতার ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির সঙ্গে আদ্যাপান্ত প্রশাসনিক ভবনটির যোগাযোগ আদৌ কি গভীর? সেদিক থেকে এই নামবদল ‘ছাপ মোছার চেষ্টা’র সার্থকতা তো দূর, যর্থাথতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেয়। ঔপনিবেশিক শাসন দেশের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু নামবদল করলেই তার প্রতিকার হবে বলে যদি কেউ মনে করেন, তাহলে কি ইতিহাসের মূল্যায়ন যথাযথ হল? ইতিহাস লেখা ভারী শক্ত, বরং বিকৃত করা সহজ। ছাপ মোছার এই উদ্যোগ বিকৃতিকেই প্রশ্রয় দেয়।’