মৃগীরোগ একটি দীর্ঘস্থায়ী স্নায়বিক ব্যাধি যার একাধিক সিনড্রোম রয়েছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ, যে কোন বয়সের মানুষকে, জীবনের যেকোন পর্যায়েই আক্রান্ত করতে পারে।
আমাদের মস্তিষ্ক বৈদ্যুতিক বার্তা প্রেরণ করেই শরীরকে নির্দেশ দেয় ও সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে। হাত-পা কেঁপে ওঠা, শরীর কাঠের মতো শক্ত হয়ে পড়া এবং জ্ঞান হারানো মৃগীরোগের বেশ কিছু লক্ষণ। বেশিরভাগ খিঁচুনিই ক্ষণস্থায়ী এবং নিজের থেকেই বন্ধ হয়ে যায় তাই কিছুটা বিপদমুক্ত থাকা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, ১৮ বছর বয়সের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ শিশুদের মৃগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অনিয়ন্ত্রিত মস্তিষ্কের কার্যকলাপ শিশুদের একাগ্রতা, মনোযোগ এবং তথ্য ধারণের প্রক্রিয়ায় সমস্যা তৈরি করে। তাদের মধ্যে ইম্পালস নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকে ফলে খুব সহজেই তারা আক্রমণাত্বক হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন - Maghi Purnima Snan Benefits: মাঘী পূর্ণিমায় বিশেষ সংযোগে করুন স্নান ও দান, খুলবে ভাগ্যের বন্ধ তালা
মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন ধিরুভাই আম্বানি হাসপাতালের শিশুস্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ বিভাগের পরামর্শকারী চিকিৎসক ডঃ সায়লি বিডকর জানাচ্ছেন, কীভাবে একটি শিশু মৃগীরোগ দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং তার প্রাথমিক চিকিৎসা কীভাবে করবেন। -
১) বাচ্চা ডেলিভারির সময় যদি মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয় বা ডেলিভারি যদি খুবই কষ্টকর হয় তবে হাইপোক্সিয়া জনিত কারণে এই রোগ হতে পারে। কারণ, হাইপোক্সিয়ায় মূলত দেহে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়।
২) জন্মের পর পরই হাইপোগ্লাইসেমিয়া অর্থাৎ রক্তে শর্করার মাত্রা কম।
৩) অকালীন অন্তঃপ্রকোষ্ঠীয় রক্তক্ষরণ অথবা পেরিভেন্ট্রিকুলার লিউকোম্যালাসিয়া (PVL) হেতু মস্তিষ্কের সাদা পদার্থটি আঘাত পেলেও তা দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে যার ফলস্বরূপ ভবিষ্যতে মৃগী হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
৪) যেসব শিশু মস্তিষ্কের জ্বরে ভুগছে, যা মেনিনজাইটিস নামেও পরিচিত, তাদের মৃগীরোগ হতে পারে।
৫) মস্তিষ্কের বিকাশে কাঠামোগত অস্বাভাবিকতা, যেমন - লিসেনসেফালি - এটি মস্তিষ্কের একটি বিরল জন্মগত ত্রুটি যার ফলে মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্স অস্বাভাবিকভাবে মসৃণ হয়ে যায়। এছাড়াও মাইক্রোগাইরিয়া অর্থাৎ অস্বাভাবিকভাবে ছোট মস্তিষ্কের ভাঁজ এই বিষয়গুলি মৃগীরোগ হওয়ার সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে থাকে।
৬) মৃগীর পারিবারিক ইতিহাস বা জেনেটিক্স।
কারোর খিঁচুনি উঠলে কী করবেন ?
- আতঙ্কিত হবেন না; শান্ত থাকুন।
- কাছাকাছি থাকা যেকোনো বিপজ্জনক জিনিসপত্র সরিয়ে রোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।
- জামার কলারের ঢিলা করে দিন এবং মাথার নীচে একটি নরম বালিশ রাখুন।
- রোগীকে তার পাশে ঘুরিয়ে দিন (বাম পাশে অথবা ডান পাশে) যাতে শ্বাসরোধ না হয়।
- রোগীকে আটকাবেন না বা তাদের নড়াচড়া বন্ধ করার চেষ্টা করবেন না।
- তাদের মুখে কিছু দেবেন না
- খিঁচুনি কম না হওয়া পর্যন্ত রোগীর সঙ্গে থাকুন।
শৈশবকালীন মৃগীরোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে 'ডায়েটারি থেরাপি' একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অথচ প্রায় অব্যবহৃত হাতিয়ার। গবেষণায় দেখা গেছে যে ডায়েটারি থেরাপি, বিশেষ করে কিটোজেনিক ডায়েট (KD), জীবনযাপনের মান উন্নত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক।
নভি মুম্বাইয়ের ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগের পরামর্শদাতা ডঃ বিশাল চাফালে পরামর্শ দেন, "এই ডায়েটগুলিতে থাকা শিশুরা বাদামের আটার ধোসা, পনির ভুরজি, নারকেল লাড্ডু এবং ডিম-জাতীয় খাবার খেতে পারে কারণ তা উপভোগ্যও এবং পুষ্টির পর্যাপ্ততাও নিশ্চিত করে।
তবে, ডায়েট মেনে চলার জন্য ধৈর্যশীল হতে হবে, পাশাপাশি চিকিৎসার তত্ত্বাবধান প্রয়োজন। কোষ্ঠকাঠিন্য, অ্যাসিডোসিস বা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ভারসাম্যহীনতার মতো ঘাটতি বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ করার জন্য শিশু স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ডায়েটিশিয়ানদের অবশ্যই শিশুর বৃদ্ধি, পুষ্টির ভারসাম্য, কিডনির কার্যকারিতা এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।"
যেসব ট্রিগার সম্পর্কে আপনার সচেতন থাকা উচিত -
১) উত্তেজনা - মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষের মধ্যে স্বাভাবিক সংযোগ ব্যাহত হলে
২) বয়ঃসন্ধিকালে সময় হরমোনের পরিবর্তন
৩) আলোর ঝিকিমিকি বা ঝলকানি থেকেও শুরু হতে পারে খিঁচুনি, তবে এটি শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সঙ্গে এই প্রবণতা কমে আসে।
৪) পর্যাপ্ত পরিমাণ জল পান না করা, ঘুমের অভাব এবং সময়মতো না খাওয়া।
৫) ওষুধ মিস করলেই হতে পারে অসুবিধা। তাই সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
যেগুলিকে 'না' বলবেন -
১) মিষ্টি, চিনিযুক্ত খাবার, কার্বনেটেড পানীয়, চকলেট, চা বা কফি
২) তাপমাত্রার অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন, যেমন গরম স্নান বা খুব গরম আবহাওয়া।
৩) আলোকিত পর্দা, টেলিভিশন, ফ্ল্যাশ লাইট।
৪) সিঁড়ি বেয়ে ক্রমাগত ওঠানামা করা।
৫) শিশুকে কোনও জলাশয়ের কাছে যেতে দেবেন না।
শ্রমসাধ্য হলেও এর সুফল অনস্বীকার্য। যে শিশু একসময় ঘন ঘন খিঁচুনির সম্মুখীন হত, সে একটি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে, স্কুলে মনোযোগ দিতে পারে, বন্ধুদের সাথে খেলতে পারে এবং ক্রমাগত চিকিৎসার হস্তক্ষেপ ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে।
মৃগীরোগের কারণগুলি সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে নির্দেশ করলে এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা সময়মত চিকিৎসা পেতে পারে এবং সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে।