বর্ধমান: নামার তাড়াহুড়োয় টাল হারিয়ে ফেলেছিলাম। পাশের জন না ধরলে ট্রেন আর স্টেশনের ফাঁকে ঢুকে যেত পা। সৌভাগ্য যে তেমনটা হয়নি। চোখের সামনে ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল কিছু সম্ভাব্য দৃশ্য। ভয় । ভয়ও তো জীবনের অংশ। নিদারুণ দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও কত মানুষ বাঁচে। বাঁচার লড়াই করে। বর্ধমানে নামার সময় ঘটেছিল ঘটনাটা। কাকতালীয়ভাবে যাঁর খোঁজে নেমেছিলাম, তিনিও একদা এমন দুর্ঘটনার শিকার। কিন্তু প্রাণশক্তিকে মৃত্যুর টান হারিয়ে দিতে পারেনি। জীবনের অভিমুখেই তিনি যাত্রা করেছেন, করছেন। বেঁচে থাকার লড়াই শুধু হাসপাতালে করতে হয়নি, আজও করতে হচ্ছে। অন্য়ভাবে, পাঁচজনের থেকে আলাদাভাবে।
ডাস্টবিনের সামনে ঠাঁই
সকাল থেকেই স্টেশনে অফিসযাত্রীদের ভিড়। ভিড় এড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলাম পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। সামনেই ঝাঁ চকচকে প্রসেসড ফুডের স্টল। পাশেই একটা ডাস্টবিন। তার ঠিক সামনেই বসে এক প্রৌঢ়। ৫৪ বছর বয়সী পাঁচু গোপাল চক্রবর্তী। বিগত ২৬ বছর ধরে খবরের কাগজ বিক্রিই পেশা। সংসারের চাপে ক্লাস থ্রি-র পর পড়াশোনার পাট চুকে গিয়েছিল। আগে ট্রেনে ট্রেনে ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন । বর্ধমান থেকে ব্যান্ডেল ছিল ব্যবসার মূল ‘ক্ষেত্র’। সেই লাইনেই একদিন পাঞ্জাব মেলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। কাটা পড়ে এক পা। তখন ১৪ বছর বয়স। বাড়িতে অক্ষম বাবা-মা। একমাত্র ছেলের এমন দুর্ঘটনা পরিবারকে কতটা অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়, তা নতুন করে বলে দিতে হয় না। কিন্তু গল্প এখানে শেষ নয়, শুরু। পা হারিয়ে হাসপাতাল থেকে ক্রাচকে সঙ্গী করে নিয়েছিলেন পাঁচুবাবু। আরেক সঙ্গী হল লড়াই। ফের দিন আনি দিন খাইয়ের ব্র্যাকেটে প্রবেশ করলেন, এক পায়ে হেঁটে!
আরও পড়ুন - HT Bangla Exclusive ভরাপেটে শিয়ালদা গেলেও খিদে পাচ্ছে কেন? ‘রাজু’কীয় পকেট পরোটার রহস্যের টানে হাজির HT বাংলা
‘কাগজের দাম ছিল ৭০ পয়সা’
কত বছর বয়স থেকে খবরের কাগজ বিক্রি করছেন? মনে করতে পারেন না পাঁচু গোপাল চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, ‘বয়স মনে নেই। তখন খবরের কাগজের দাম ছিল ৭০ পয়সা। যুগান্তর, স্টেটসম্যান, সত্যযুগ, অমৃতবাজার এগুলো বেচতাম। বরুণবাবু তখন অমৃতবাজারের প্রেসে কাজ করছেন (বরুণবাবু তখন আনন্দবাজারে সাংবাদিক ছিলেন এটাই বোধহয় বোঝাতে চেয়েছিলেন)।’ বাড়িতে কে কে আছে জিজ্ঞেস করাতে বাড়াতে কে কে আছেন? বউ আর এক ছেলে। ছেলে মেমারির একটি লজে কর্মরত। হোটেল বয়। এখনও বিয়ে হয়নি। অন্যদিকে স্ত্রী গৃহিণী।
রোজকার রোজগার ১৫০-২০০ টাকা
খবরের কাগজ নিয়ে কারবার বলে ভোর ভোর পাঁচুবাবুর রুটিন শুরু হয়। বর্ধমান স্টেশনের বাইরে এক জায়গা থেকে কাগজ নিয়ে আসতে হয়। সকাল সাতটার মধ্যে চলে আসেন পাঁচ নম্বরে। নিজের বরাদ্দ জায়গায় বসে পড়েন কাগজ সাজিয়ে। বেলা বারোটা পর্যন্ত সেখানেই কাটে। কোনও দিন ১৫০ টাকা, কোনও দিন ২০০ টাকা। রোজকার এই সামান্য আয়ই সংসার চালানোর সম্বল। খবরের কাগজের দাম তো বেড়ে,ছে বিক্রেতাদের লাভ বাড়েনি? পাঁচুবাবুর কথায়, যা ছিল তাই আছে। অবস্থার কোনও বদল হয়নি। এভাবেই সংসার চালাতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন - HT Bangla Exclusive ছাদ ফুটো, ল্যাব খাঁ খাঁ! ইউটিউব চালিয়ে ছাত্র পড়াচ্ছে গর্বের প্রেসিডেন্সি
‘হেরে যেতে নেই’
দুঃখ আছে, কষ্ট আছে। তবুও মুখে হাসি ৫৪ বছর বয়সি পাঁচু গোপাল চক্রবর্তীর। ব্যান্ডেল থেকে বর্ধমান লাইনের কমবেশি সব হকারই চেনেন পাঁচবাবুকে। যাওয়ার পথে ট্রেনে খোঁজ নিয়েছিলাম এক বই বিক্রেতার কাছে। বর্ধমান স্টেশনে, ক্রাচ নিয়ে হকারি করেন পাঁচুবাবু — ওঁকে কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন? বলে দিলেন, পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মের সিঁড়ি থেকে নেমেই দেখবেন দাদা বসে আছেন। ভিডিয়ো করতে দেখে স্টেশনের আরেক হকার কৌতুহল হয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ক্যামেরা বন্ধ করতেই বললেন, পাঁচুদাকে দেখেই আমি এই লাইনে। হেরে যেতে নেই। দাদাই শিখিয়েছেন!