কলকাতা: শিয়ালদা মেট্রোর সামনে থেকে রাস্তাটা সোজা বৌবাজার চলে গিয়েছে। ভোর ভোর ব্রিজের তলা দিয়ে ওপারে গিয়ে বামদিকে ঘাড় ঘোরালেই দেখা যাবে একটা ছোট্ট জটলা। আরেকটু ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে উপর থেকে কিছু মোবাইল তাক করা, ভিড়ের মধ্যিখানে। গণ্ডগোল লেগেছে? সেই ভেবে কাছে এগিয়ে যেতেই পারেন। গেলে অবশ্য ভুলটা ভাঙবে। শুনতে পাবেন ‘তিনটে কুড়ি টাকা’, সঙ্গে আরও নানা কথা।‘বক্তা’ রাজু ঘোষ। ওরফে রাজুদা। ফেসবুক, ইউটিউব, শিয়ালদার শিশির মার্কেটে তিনি এই নামে বিখ্যাত। বিখ্যাত তাঁর পকেট পরোটা আর আনলিমিটেড তরকারির জন্য। ‘রাজুদার পকেট পরোটা’ — অন্যতম জনপ্রিয় সোশাল মিডিয়া সার্চ টার্ম (Raju Dar Pocket Paratha)।
দশ বছরের পুরনো বিকিকিনি
ফেসবুকে যাঁরা ফুড ব্লগিং করেন, তাঁদের সিংহভাগই ঘুরে এসেছেন রাজুদার ‘ধাম’। শিয়ালদার বিদ্যাপতি সেতুর যে শাখা চলে গিয়েছে মৌলালির দিকে, তার তলায় বর্তমান শাসক দলের একটি পার্টি অফিস। অফিসের এক পাশে ফুটপাতের উপর রাজুদার বিকিকিনি। অস্থায়ী। তবু দশ বছরেরও বেশি পুরনো ওই ফুটপাতটুকুর সঙ্গে তাঁর গভীর আত্মীয়তা। তাই অনেককেই বলেন ওখানে তাঁর ‘দোকান’ (Raju Dar Pocket Paratha)। রিলের দৌলতে রাজুদার সঙ্গে কমবেশি অনেকেই পরিচিত। তাই বিশদে বলা জরুরি নয়। উত্তর চব্বিশ পরগনার গুমার বাসিন্দা এই তরুণ রাত জেগে সপরিবারে পরোটা বানান। ভোর ৩টের সময় বনগাঁ লোকাল ধরে শিয়ালদা এসে তরকারি সহযোগে বিক্রি করেন। গোটা দিন জুড়েই চলে হাড়ভাঙা খাটুনি। অফিসযাত্রী থেকে হাসপাতালের রোগীর আত্মীয়, সবজিপাতির দোকানদার থেকে ভ্যানচালকদের সকালের জলখাবারের ঠিকানা রাজুদা (Raju Dar Pocket Paratha)।
কেন রাজুদা এত ভাইরাল?
রাজুদার মতো ঠিকানা গোটা শিয়ালদা বাজারে একটাই রয়েছে, তা কিন্তু নয়। একটু খোঁজ করলে দেখা যাবে, শিয়ালদা সাউথ, মেইন, শিশির মার্কেট ও অন্যান্য মার্কেটগুলো মিলিয়ে এমন পরোটা বিক্রেতার সংখ্যা প্রায় ৫০-র কাছাকাছি। তাহলে রাজুদাই কেন ভাইরাল? তাঁর ‘৩টে পরোটা ২০ টাকা আর একটি ডিম নিয়ে ৩০ টাকা’ নেটিজেনদের কি আরও বেশি কিছু দিচ্ছে? কী এমন জিনিস সেটা যে বাংলাদেশ থেকেও মানুষ কলকাতা এলে দেখা করেন রাজুদার সঙ্গে? এই প্রসঙ্গেই বেশ কয়েকজন ফুড ব্লগারদের সঙ্গে কথা বলল HT বাংলা।
‘পায়েলের রান্নাঘর ও লাইফস্টাইল’ পেজের ক্রিয়েটর পায়েল মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘রাজুদার মতো অনেকের দোকানেই বেশ ভিড় থাকে। কিন্তু রাজুদার স্পেশালিটি তাঁর কথা। ফেসবুক, ইউটিউবে ভাইরাল হলে অনেকের ঘ্যাম, অহংকার বেড়ে যায়। কিন্তু রাজুদার মধ্যে এখনও সেটা আসেনি। আমরা অনেকের ভিডিয়ো করি ঘুরে ঘুরে। ওঁর মতো সরল মানুষ খুব কম।’
‘কাস্টমারের সঙ্গে বিহেভিয়ার খুবই ভালো’
একই সুর ‘রাজ আনকাট’ পেজের ক্রিয়েটর রাজ সাহার কথায়। রাজের মতে ‘কাস্টমারের সঙ্গে রাজুদা খুবই ভালো ব্যবহার করেন। যে কারণে তাঁর কাছে কাস্টমাররা বারবার আসে। আরেকটা কথা দাদা সবাইকেই বলেন, আগে খেয়ে নিন, পরে টাকা দিন। এই গুণটা খুব কম দোকানদারের মধ্যে দেখা যায়। অধিকাংশ জায়গায় আগে টাকা নিয়ে নেয়। আবার এর জন্য মাঝে মাঝে লসও হয়। অনেকেই খেয়ে টাকা দেন না বা দিতে ভুলে যান। ব্যাপারটা খারাপ লাগলেও রাজুদাকে কখনও রেগে যেতে দেখিনি।’ মৌলালির ইনসুরেন্স সংস্থায় কাজ করেন প্রণব বারিক। তাঁর কথায়, ‘গত ৩-৪ বছর এখানে অফিস করছি। প্রথম দিন থেকেই রাজুদার পরোটা খাওয়া আমার রুটিন। ওর ব্যবহার নিয়ে কোনও কথা হবে না!’
স্বাদের নিরিখে আলাদা
রাজ সাহার কথায়, ‘রাজুদার সবচেয়ে বড় অ্যাডভান্টেজ দাদা বাড়িতে পরোটা বানান। ওর ফ্যামিলি মেম্বাররা সবাই মিলে ওকে হেল্প করেন। অন্য দোকানদাদের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। হাবড়াতে বেশ কয়েকটা পরোটা কারখানা রয়েছে। শিয়ালদার অধিকাংশ দোকানদার সেখান থেকে পরোটা নিয়ে আসেন। ওই জন্য সকলের তরকারির স্বাদ একরকম। কিন্তু রাজুদার তরকারি টেস্ট অন্যরকম।’ বয়স্ক ভ্যানচালক হরেন মিস্ত্রির কথাতেও একই সুর। শিয়ালদা চত্ত্বরে ভ্যান টেনেই তাঁর দিন চলে। তিনি দিন শুরু করেন রাজুদার পরোটা খেয়ে। হরেনের কথায়, ‘ভোর ভোর চলে আসি রাজুর দোকানে। পেট ভরে খেলেই ভ্যান টানার তাকত আসে।’
পরোটা সেলিং স্ট্র্যাটেজি!
রাজের কথায়, ‘দাদা নিজে বানান বলেই বেশি প্রফিট থাকে অন্যদের তুলনায়। অনেকসময়ই দেখা যায়, কেউ নটা পরোটা চাইলে দশটা দিয়ে দিচ্ছেন। মার্জিন বেশি থাকে বলে দিতে পারেন।’ প্রসঙ্গত, রাজুদার আরেকটি ‘ইউএসপি’ আনলিমিটেড তরকারি। যতক্ষণ পরোটা থাকবে, ততক্ষণ তরকারি দেবেন তিনি। কিছু রিল জানান দিচ্ছে, এই করতে গিয়ে কোনও কোনও দিন তরকারি শেষ হয়ে যায়, কিন্তু পরোটা বেঁচে যায়। তখন বেঁচে যাওয়া পরোটা স্টেশনের অন্য দোকানদারদের অল্প অর্থের বিনিময়ে দিয়ে দেন। লাভ কমে যায়, কিন্তু সে নিয়ে দুঃখ করতে বিশেষ দেখা যায় না তাঁকে!
শরীরে রাগ কম!
‘রমা’স লাইফস্টাইল’ পেজের ক্রিয়েটর রমা মজুমদারের কথায়, ‘ ব্লগারদের ভিড়ে মাঝে মাঝে দাদার ব্যবসার অনেক ক্ষতি হয়। কিন্তু রাগ করলেও খারাপভাবে কারও সঙ্গে কথা বলেন না। হাতজোড় করে বিনীতভাবে বলেন। কোনও কিছু পছন্দ না হলে অনুরোধের সুরে বারণ করেন। এই যেমন কিছুদিন আগে করেছিলেন। দাদা সাধারণত রাত এগারোটা-বারোটায় পরোটা বানাতে বসেন। ভাইরাল হওয়ার জেরে এখন রাতের বেলা তাঁর বাড়িতে ফুড ব্লগাররা চলে যাচ্ছেন ভিডিয়ো করতে। এই ব্যাপারটা নিয়ে দাদা খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন। একটি রিলে তিনি হাতজোড় করেই সবাইকে বারণ করেছিলেন। পাড়া ও সমাজের কথা বলে ব্লগারদের অনুরোধ করেন, অত রাতে তাঁর বাড়ি না আসতে। এই ভালোমানুষিটাই রাজুদাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয়।’
কথা বেচে খাওয়া
ব্যবসা করলে সবাইকেই অল্পবিস্তর কথা বেচে খেতে হয়। কিন্তু রাজুদার কথা বেচবার মধ্যে যে আন্তরিকতা রয়েছে তা কিন্তু অন্য অনেকের মধ্যে নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্লগার জানাচ্ছেন, ‘বাঘাযতীনের একজনের পরোটাও খুব ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু কথা বেচতে বেচতে তাঁর গল্পের গরু গাছে উঠে যায়। যে কারণে নেটিজেনদের থেকে নেগেটিভ কমেন্ট আসে প্রচুর। রাজুদা ইদানিং ভাইরাল বলে একদল লোক ফেসবুকে তাঁকে নিয়ে ট্রোল করছেন। কিন্তু দাদার ব্যবহার, আন্তরিকতা নিয়ে নেগেটিভ কমেন্ট কাউকে করতে দেখিনি। আসলে করার জায়গাই নেই।’
ভাইরাল-রহস্যের আসল ‘মন্ত্র’
‘ট্রেন্ডস ইন বেঙ্গল’ পেজের ক্রিয়েটর দেবরাজ দাসের মতে রাজুদার ভাইরাল হওয়ার পিছনে অন্য একটি তত্ত্ব রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘ফেসবুকের নিজস্ব একটি অ্যালগোরিদম আছে। সেই মোতাবেক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তির রিল ফেমাস হয়। যেমন একসময় ফেমাস হয়েছিল ‘কাঁচা বাদাম’,‘রাণু পাল’ - এঁরা। ঠিক সে অ্যালগোরিদম মেনেই রাজুদা এখন ভাইরাল। তাই যে-ই দাদার ভিডিয়ো করছে, সে-ই ভিউ পাচ্ছে।’ তবে প্রযুক্তির কলকাঠির পাশাপাশি যে কথা দেবরাজও স্বীকার করছেন, তা হল ‘রাজুদার সরলতা। ভীষণ সাদাসিধে একটা মানুষ।’ ঘোরপ্যাঁচ জানেন না!
ভাইরাল হওয়ার একপাশে যেমন থাকেন ব্লগার ও ভাইরাল হওয়া ব্যক্তি, অন্যপাশে থাকেন সাধারণ মানুষ। রাজুদার সম্পর্কে সবাই কমবেশি এক বাক্যে মানেন তাঁর সরলতা, ভালোমানুষির কথা। কমেন্টে, রিলে, ব্লগার ও খদ্দেরদের মুখে এরই ছড়াছড়ি। তাই পরোটা, ডিম, আনলিমিটেড তরকারি, ফেসবুক, ইউটিউব, অ্যালগোরিদম, সেলিং স্ট্র্য়াটেজি — সব কিছু একপাশে রেখে রাজুদাকে দিকে তাকালে বোঝা যায়, আদতে ভাইরাল হচ্ছে সরলতা, ভালোমানুষি। আদতে ভাইরাল হয় সরলতা, ভালোমানুষি। আত্মকেন্দ্রিক জগতে দাঁড়িয়ে হয়তো এটাই মানুষ আরও বেশি চায়।