সরকারের উদাসীনতা সত্ত্বেও বেসরকারি উদ্যোগে সামান্য হলেও যে পরিবর্তন আনা সম্ভব, উগান্ডার এক প্রতিষ্ঠান তা দেখিয়ে দিচ্ছে৷ বেড়ে চলা প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের এক কর্মসূচি শরণার্থীদের আয়েরও সুযোগ দিচ্ছে৷
উগান্ডার শরণার্থী শিবিরে জীবনযাত্রা মোটেই সহজ নয়৷ কিন্তু ডোরিস কাভিরা অর্থ উপার্জনের এক নতুন পথ খুঁজে পেয়েছেন৷ তিনি গোটা ক্যাম্প জুড়ে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করেন৷ এমনকী যে ছোট একফালি জমিতে তিনি কিছু শাকসবজির চাষ করেন, সেখানেও এমন বোতল পড়ে থাকে৷ তিনি এক রিসাইকেল কোম্পানির কাছে সেই প্লাস্টিক বোতল বিক্রি করেন৷ ডোরিস জানালেন, ‘আমি মাসে প্রায় ২৪ ইউরো রোজগার করি৷ ক্রেতা প্লাস্টিকের বস্তা ওজন করেন৷ আমি ২৪ ইউরো পাই, তবে বস্তা ভারি হতে হবে।’
ডোরিস প্রায় আট বছর আগে গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর যুদ্ধকবলিত নর্থ কিভু প্রদেশ থেকে পালিয়ে আসেন৷ তিনি উগান্ডায় বসবাসরত প্রায় ১৭ লাখ শরণার্থীদের একজন৷
বেশিরভাগ শরণার্থী প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ সুদান, গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো এবং বুরুন্ডি থেকে এসেছেন৷ এই সব দেশ সংকট ও গৃহযুদ্ধে জর্জরিত৷ ফলে উগান্ডায় আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বেশি শরণার্থী বাস করেন৷ তাঁদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো বিশাল এক চ্যালেঞ্জ।
ডোরিস কাভিরা উগান্ডার পশ্চিমে কিয়াংওয়ালি শরণার্থী বসতিতে নতুন করে জীবন শুরু করছেন৷ তাঁর বাগানের কাছেই বর্জ্য সংগ্রহের এক কেন্দ্র রয়েছে৷ বিক্রির বাবদ আয় তাঁর মোবাইল অ্যাকাউন্টে পয়েন্ট হিসেবে জমা হয়৷ তিনি সেই পয়েন্ট দিয়ে দোকানে কিছু কিনতে পারেন অথবা নগদ টাকা তুলতে পারেন৷শ রণার্থী ও ইকোপ্লাস্টাইল সংস্থার এজেন্ট হিসেবেমোরেস বাংগা বলেন, ‘মানুষ আরো প্লাস্টিক আনলে আমাদের পরিবেশের উপকার হয়৷ প্লাস্টিক পরিবেশের শ্বাসরুদ্ধ করে৷ প্লাস্টিক মাটির উর্বরতা ধ্বংস করে দেয়, মাটি তার উর্বরতা হারায়৷ আমরা প্লাস্টিক সংগ্রহের কাজ চালিয়ে গেলে মাটি আবার উর্বরতা ফিরে পাবে।’
উদ্যোগপতি হিসেবে ফ্র্যাংক কামুগিয়িশা-র মনে প্লাস্টিককে ব্যবসায় রূপান্তরিত করার আইডিয়া এসেছিল৷ তিনি ও তাঁর টিম এক অ্যাপ সৃষ্টি করে এক বছর আগে দুটি জায়গায় সেই কর্মযজ্ঞ চালু করেছিলেন৷ উগান্ডার পূর্বে জিনজা এবং পশ্চিমে এই রিফিউজি ক্যাম্পে ইকোপ্লাস্টাইল সংস্থা সেই উদ্যোগের সূচনা করেছে৷ ফ্র্যাংক বলেন, ‘আমাদের মতে, দশ লাখেরও বেশি শরণার্থী ব্যবসা হিসেবে রিসাইক্লিং-এর কাজ করবেন, এমনটা অবশ্যই সম্ভব৷ প্লাস্টিক রিসাইক্লিং থেকে তারা দিনে এক ডলার আয় করতে পারেন৷ ফলে পরিবেশও অনেক সাফ হয়ে যাবে৷ আমরা সেটা করতে পারলে আমরা এক ঢিলে তিন পাখি মারতে পারি৷ অর্থাৎ মানুষ, গ্রহ ও সমৃদ্ধির প্রতি মনোযোগ দিতে পারি।’
ক্যাম্প থেকে বর্জ্য প্লাস্টিক কাম্পালা শহরের কাছে কোম্পানির কারখানায় নিয়ে আসা হয়৷ সেখানে প্লাস্টিক টুকরো করে গলিয়ে ছাদের টাইলে রূপান্তরিত করা হয়৷ প্রচলিত মাটির টাইলের তুলনায় সেই টাইল বেশ হালকা এবং উৎপাদন ব্যয়ও কম৷ তাতে নানা রং যোগ করা যায়৷ এমনকি সেগুলি প্রাকৃতিক মাটি বা কংক্রিটের রংয়েরও হতে পারে৷ কাম্পালার অনেক বাসার ছাদে ইতোমধ্যেই এমন টাইল বসানো হয়েছে৷ ফ্র্যাংক কামুগিয়িশা জানান, ‘আমরা একশোভাগ প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে সেগুলি তৈরি করি৷ সেগুলির রং ইটের মতো লাল, দেখতে প্রচলিত মাটির টাইলের মতো৷ কিন্তু সেগুলির ওজন দুই গুণ কম৷ ভাঙার কোনো সম্ভাবনা নেই৷ নির্মাণের ব্যয়ও কমিয়ে দেয়।’
গত বছর এই কোম্পানি পাঁচ লাখ কিলোরও বেশি ওজনের প্লাস্টিক বোতল রিসাইকেল করেছে৷ এমন ছোট এক কোম্পানির জন্য সেটা যথেষ্ট বড় কর্মযজ্ঞ৷ কিন্তু সেই সংখ্যা পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে অতি নগন্য৷ কারণ সে দেশে বছরে প্রায় দুই লাখ বিশ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সৃষ্টি হয়৷ এখনো পর্যন্ত উগান্ডার সরকার প্লাস্টিক বর্জ্য কমানোর কোনো পরিকল্পনা করে নি৷ জাতীয় স্তরে কোনো রিসাইক্লিং সিস্টেম না থাকায় পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা অত্যন্ত হতাশ৷ মাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ জোয়েল কিনোবে বলেন, ‘উগান্ডায় তিন শতাংশেরও কম প্লাস্টিক রিসাইকেল করা হয়৷ বাকি অংশ পরিবেশের কোলে ফেলে দেওয়া হয়।’
এর ফলে গোটা দেশজুড়ে প্লাস্টিক বর্জ্য বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে৷ সাধারণত স্থানীয় স্তরের সংগঠনগুলি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে৷ কিয়াংওয়ালি রিফিউজি ক্যাম্পে কেয়ার ইন্টারন্যাশানাল নামের এনজিও ইকোপ্লাস্টাইল সংস্থার সহায়তায় প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের উদ্যোগ নিচ্ছে৷
ক্যাম্পে এই উদ্যোগের খবর ছড়িয়ে পড়ার ফলে এক হাজারেরও বেশ শরণার্থী ‘ট্র্যাশ ফর ক্যাশ' কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন৷ এমন কর্মসূচির ফলে পরিবর্তন লক্ষ্য করছে সেই এনজিও৷ কেয়ার ইন্টারন্যাশানালের উগান্ডা শাখার প্রতিনিধি অ্যাফ্রিকান মুহাংগি বলেন, ‘গত তিন মাসে আমরা ১৩ টন পর্যন্ত প্লাস্টিক সংগ্রহের কাজ দেখেছি৷ এটা সত্যি বিশাল পরিমাণ বটে৷ শুধু পরিবেশ থেকেই প্লাস্টিক সরিয়ে ফেলা হচ্ছে না, সংগ্রহকারী, এগ্রিগেটর ও প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কর্মীদের উপর আমদের বিনিয়োগের সুফলও দেখতে পাচ্ছি।’
প্রণোদনা হিসেবে অ্যাপ-টির কল্যাণে এখন রিসাইক্লিং-এর জন্য আরো প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে৷ ফ্র্যাংক কামুগিয়িশা যখনই কিয়াংগোয়ালিতে যান, সবাই তাঁকে অ্যাপ-টির ব্যবহার দেখানোর অনুরোধ করেন৷ অনেক শরণার্থীর জন্য সামান্য আয়ও বড় পরিবর্তন আনতে পারে৷ শরণার্থী ও প্লাস্টিক সংগ্রহকারী নোয়েলা সুবিরা বলেন, ‘এই ক্যাম্পে বেশিরভাগই একা মা রয়েছে৷ আমরা আর স্বামীদের সঙ্গে থাকি না৷ তারা শিশুসহ আমাদের ত্যাগ করেছে৷ কিন্তু এই ব্যবসা আমাদের সাহায্য করেছে, কারণ প্রতিদিন সকালে আমাদের কিছু করার আছে৷’
ফ্র্যাংক কামুগিয়িশা ও ডোরিস কাভিরা নতুন এক পথে পাড়ি দিয়েছেন৷ সেই উদ্যোগের সুফলও পাওয়া যাচ্ছে৷ উদ্যোগপতি হিসেবে ফ্র্যাংক অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গেও যোগাযোগ করছেন৷ অন্যান্য রেফিউজি ক্যাম্পেও নিজের কর্মসূচি চালু করতে চান তিনি৷
হিলারি আইসেসিগা, ইয়ুলিয়া মিলকে/এসবি
(বিশেষ দ্রষ্টব্য : প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া হয়েছে। সেই প্রতিবেদনই তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার কোনও প্রতিনিধি এই প্রতিবেদন লেখেননি।)