তেষ্টা পেলে মানুষ জল খায়, প্রয়োজনে নোটবুক লেখে, অসুখ হলে ওষুধ খায় কিংবা থাকার জন্য বাড়ি বানায়। আপাত দৃষ্টিতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই অরণ্যের সঙ্গে সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এগুলোর মতো আমাদের জীবনের অনেক কিছুই সরাসরি বা পরোক্ষভাবে অরণ্যর সঙ্গে যুক্ত।
আজ আন্তর্জাতিক অরণ্য দিবস। ২০১২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় এই নিয়ে ঐক্যমত্য হয় যাতে বিভিন্ন দেশ অরণ্য এবং গাছপালা নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হবে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই বিভিন্ন দেশের সবুজ ঘেরা অরণ্য ছোট হয়ে আসছে। মানুষ দিনের পর দিন নিজের প্রয়োজনে ও উন্নয়নের খাতিরে অরণ্যের বিভিন্ন অংশ গ্রাস করছে। কিন্তু সত্যিই কি এগুলো ‘উন্নয়ন’ বলা যেতে পারে?
রাষ্ট্রপুঞ্জের তথ্য অনুসারে পৃথিবীর স্থলজ জীববৈচিত্রের ৮০ শতাংশ অরণ্যে ঘেরা। যেখানে ৬০ হাজারের বেশি গাছের প্রজাতি রয়েছে। প্রতি বছর বিভিন্ন কারণে ১০ মিলিয়ন হেক্টরের বেশি অরণ্য হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বুক থেকে, যা প্রায় আইসল্যান্ডের মতো একটি দেশের সমান। পরিস্থিতি সত্যিই গুরুতর। এই বছর এই বিশেষ দিনের থিম হল ‘অরণ্য এবং প্রকৃতি উপযোগী উৎপাদন ও ব্যবহার’।
ভারতের মতো দেশে সমস্যা হল, অরণ্যের নিকটবর্তী এলাকায় যাঁরা থাকেন, তাঁরা অনেক সময়েই বঞ্চনার শিকার হন। আবার তাঁদের অরণ্যের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় থাকে না। এদিকে রাস্তা সম্প্রসারণ বা বিভিন্ন ‘উন্নয়নমূলক’ কাজের অজুহাতে অনেক সময়েই তাঁদের উৎখাত করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে নকশাল বা মাওবাদী সমস্যার দিকটিও কোনও না কোনও ভাবে অরণ্যের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু অরণ্য নিয়ে যত অ্যাকশন প্ল্যান হোক না কেন, স্থানীয় মানুষদের বাদ দিয়ে কোনও প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
নগর উন্নয়নের দৌড় পৌঁছে গিয়েছে অরণ্যে। তাই তৈরি দাঁড় করানো হচ্ছে একের পর এক মোবাইল টাওয়ার। গত দুই বছরে ভারতে এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে চিতাবাঘ বা নেকড়ে ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ঢুকে গৃহপালিত পশুকে রাতের অন্ধকারে সাবার করে দিচ্ছে বা স্থানীয় মানুষকে আক্রমণ করছে। ট্রেন লাইনে কাটা পড়েছে এরকম হাতির সংখ্যা নেহাত কম নয় খাস পশ্চিমবঙ্গে। অরণ্যের সঙ্গে মানুষের সংঘাতপূর্ণ ব্যবহারে আদপে মানুষেরই ক্ষতি হচ্ছে। তবে এই বাস্তব মানতে রাজি নন অনেকেই।
ছোটবেলায় মোগলির কাজ কারবার টিভির পর্দায় দেখতে সকলের ভালো লাগত। কিন্তু বাস্তবে আর মোগলি নেই। কারণ মানুষ কবেই প্রকৃতিকে শাসন করতে করতে অরণ্যকে বশ করে ফেলেছে। তাই পরের সুনামি যদি পৃথিবীর কোথাও হয়, অরণ্য স্রেফ মাথা নিচু করে ভবিতব্য মেনে নেবে। না হলে গানের কলিটাই হয় তো বদলে গিয়ে হবে, রোদন ভরা এ অরণ্য!