অন্য যে কোনও দেবীর তুলনায় মা কালী অনেক বেশি উগ্র, ভয়ংকর রূপ তাঁর। মা কালী কৃষ্ণবর্ণা, নগ্ন। কিন্তু কেন মায়ের এই রূপ? কীভাবে শুরু হলো মায়ের আরাধনা? কেন প্রথমে গার্হস্থ্য বাড়িতে পুজো হতো না মা কালীর?
কীভাবে প্রচলিত হলো মা কালীর পুজো?
আজ থেকে বহু বছর আগে সেন রাজাদের অত্যাচারে রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন প্রজারা। তবে শুধু সেন রাজাদের অত্যাচার নয়, বিদেশি শাসকদের অত্যাচারেও তখন অসহায় আদিবাসী বাঙালি বেঁচে থাকার নতুন আশ্রয় খুঁজছিল। সেই সময় আদিবাসীদের দেবতা ছিলেন কৃষ্ণ। কিন্তু কার্যত কিছুটা বাধ্য হয়ে কৃষ্ণ প্রেমে আচ্ছন্ন অহিংস অসহায় বাঙালিরা আশ্রয় নিলেন এক মহা শক্তির। যিনি ছিলেন কালী।
ভারতবর্ষে প্রথম থেকে মা কালীর আরাধনার কোনও চল ছিল না। জানা যায়, ঋষি বশিষ্ঠ দেবী কালীকে চীন দেশ থেকে প্রথম এই দেশে নিয়ে আসেন। মা কালী যেহেতু তন্ত্রসাধনার দেবী ছিলেন, তাই লোকচক্ষুর আড়ালে তন্ত্রমতে পূজিত হতেন মা। পরবর্তীকালে কালী প্রতিমা তৈরি করে মায়ের পুজো শুরু হলেও তা করা হতো লোকচক্ষুর আড়ালে।
তন্ত্রসাধনার দেবী মা কালীকে প্রথম ঘরের মেয়ে হিসেবে কল্পনা করেছিলেন রামপ্রসাদ। রামপ্রসাদের হাত ধরেই প্রথম তন্ত্রের দেবী বসন পরিহিত মা কালী রূপে পরিণত হয়েছিলেন। তবে তখনও উচ্চবর্ণ বা অভিজাত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে মা কালীর আরাধনার চল ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রথম নিজের বাড়িতে মা কালীর পুজো করার পর কালী পুজো জনপ্রিয়তা পায়।
(আরও পড়ুন: অলক্ষ্মী বিদায়ের পুজো শুরু কখন? কটার মধ্যে সেরে ফেলতে হবে? জেনে নিন)
মা কালীর রূপের পিছনে থাকা ইতিহাস
মা কালীর রূপ অন্য যে কোনও দেবীর থেকে অনেক বেশি ভয়ংকর। কিন্তু কেন এত ভয়ংকর রূপ ধারণ করেন তিনি? কেন মা কালী নগ্ন রূপা? প্রাচীন ইতিহাস দেখলে বুঝতে পারবেন, মা কালীর এই রূপের পেছনে রয়েছে এক দার্শনিক ভাবধারা। একথা সত্য, অতীতকালে মানুষের হাতেই দেব-দেবীরা সাকার রূপ পেয়েছিলেন।
দেব-দেবীদের মূর্তি তৈরি হতো মানুষের দর্শন, কল্পনা এবং গল্পের মাধ্যমে। আপনি যদি গভীর ভাবে কালী মূর্তি দেখেন তাহলে বুঝতে পারবেন, মা কালীর প্রত্যেকটি অঙ্গ এবং অলংকার দার্শনিক ভাবধারায় গঠিত। বহু বছরের অক্লান্ত গবেষণা এবং দর্শনভিত্তিক চিন্তাভাবনার মাধ্যমেই ফুটে উঠেছে মা কালীর এই রূপ।
মা কালী কাল বা সময়ের প্রতীক। তিনি অসীম, অনন্ত। তাঁর কোনও তল, উচ্চতা নেই। এই নিরাকার অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডকে একত্রে নিয়ে আসার জন্যই কালীর গায়ের রং কালো বা ঘন নীল। দেবীর এক হাতে থাকে খড়্গ অন্য হাতে কাটা মুন্ডু। এই খড়্গের সাহায্যে দেবী অজ্ঞানতাকে হত্যা করেন। অন্য হাতে কাটা মুন্ডু হলো জ্ঞানের আধার।
(আরও পড়ুন: কালীপুজোর শুভেচ্ছা জানান প্রিয়জনকে, পাঠান এই শুভেচ্ছাবার্তা)
দেবীর লাল জিভ সাদা দাঁত দিয়ে চেপে ধরে রাখার অর্থ হলো ত্যাগের মাধ্যমে সমস্ত পার্থিব ভোগ দমন করার চেষ্টা। ত্যাগের মাধ্যমেই ঐশ্বরিক শক্তি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা। মা কালীর গলায় ৫০টি কাটা মুন্ডু ৫০টি বর্ণ বা ভাষার প্রতীক, যার মাধ্যমে মানুষ জ্ঞানের প্রকাশ ঘটাতে পারে। হাতের কোমর বন্ধনী কর্মকে দিকনির্দেশন করে। কালী মূর্তির ত্রিনয়ন সূর্য, চন্দ্র এবং অগ্নির প্রতীক।
কালী প্রতিমার নিচে থাকা শিবের উপস্থিতি স্থিতির প্রতীক, যেখানে স্বয়ং মা কালী গতির প্রতীক। এইভাবেই দার্শনিক ভাবনা থেকে কালী মূর্তির আবির্ভাব হয়েছিল। পার্থিব কোনও ভোগ লালসা নয়, সমস্ত মায়া ত্যাগ করার মাধ্যমেই মা কালীর কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া সম্ভব।