মুজিবর রহমান বাংলা ভাষায় এক স্পর্ধার নাম। আজ ওঁর জন্মদিন। বঙ্গবন্ধুর জীবনের খুব উল্লেখযোগ্য কিছু বছর কেটেছিল এই কলকাতায়। তখন কেউ ঠাহর করতে পারেননি, একদিন এই মানুষটিই শুধু বাংলা ভাষা, মানবিকতা ও লড়াকু মানসিকতা সম্বল একটি দেশ তৈরি করবেন, যেখানে দ্বেষের কোনও স্থান থাকবে না। ইতিমধ্যেই বঙ্গবন্ধুর জনশতবর্ষ পালিত হয়েছে দেশ-বিদেশ জুড়ে। এপার বাংলায় ওঁকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক। কিন্তু ওঁর জীবনে কলকাতার প্রভাব নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
তখন চল্লিশের দশক। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের লড়াই তখন চরমে। যুবক মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে (আজকের মৌলানা আজাদ কলেজ) উচ্চমাধ্যমিকে পাঠ গ্রহণের জন্য ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে উনি পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় ফিরে যান। এই চারটি বছর ওঁকে ভবিষ্যতের কঠিন রাজনৈতিক লড়াইয়ের জন্য তৈরি করেছিল। বলতে গেলে, যুবক অবস্থায় তার রাজনৈতিক সত্ত্বা তৈরি হয় এই কলকাতায়। কাকতলীয় হলেও সত্যি, ১৯৪৭ এর পর ওঁর কলকাতায় আসা হয় ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। দীর্ঘ তিন দশক ওঁর আসা না হলেও, এই শহরের মানুষ, শহরের আবেগ এবং মানবিকতা ওঁর জন্য বরাদ্দ ছিল অনেকটাই। তাই মুক্তিযুদ্ধে এপার বাংলার মানুষদের ভূমিকাও নেহাৎ কম নয়। এখনও কলকাতার রাস্তাঘাট, চেনা অচেনা মহল্লা, সবুজ ময়দান, অগুনতি কালো মাথার মিছিল, আরও কত কিছু বীর যুবক মুজিবর রহমানের স্মৃতি পরম স্নেহে স্মরণ করে।
বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে কলকাতার সম্পর্ক নতুন নয়। কলকাতা বন্দরকে ঘিরে একসময় ব্যবসা গড়ে উঠেছিল শেখ বংশের। তবে বালক মুজিবের প্রথমবার কলকাতায় আসার স্মৃতি সুখের ছিল না। বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়ে হার্ট দুর্বল হয়ে পড়ায় কলকাতায় দীর্ঘদিন চিকিৎসার থাকতে হয় তাঁকে। এর পরে গ্লুকোমা ধরা পড়লে কলকাতায় নামজাদা চক্ষু চিকিৎসকের কাছে সফল অপারেশন হয় তাঁর চোখের। কলকাতা কোনও দিন খালি হাতে ফেরায়নি তাঁকে! এর পরে তাঁর আসা হয় কলকাতায় পড়াশোনা করতে। মাঝখানে কেটে গেছে কয়েকটি বছর…
নেতৃত্ব দেওয়ার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি তার মধ্যে ছিল সব সময়েই। এর প্রথম প্রতিফলন দেখা যায় যখন ইসলামিয়া কলেজের স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত হন মুজিব। সমসাময়িক বন্ধুরা অনেকেই শক্তিশালী সংগঠক হিসেবে তার প্রশংসা করেছিলেন। তবে কলকাতা অনেক কঠিন সময়ের অভিজ্ঞতা দিয়েছে তাঁকে। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ যেমন ছিল তাঁর মধ্যে, আবার ব্রিটিশদের মাত্রাছাড়া নিপীড়নও!
বঙ্গবন্ধুর জীবনে সোহরাওয়ার্দির সঙ্গে সাক্ষাৎ ছিল মস্ত বড় টার্নিং পয়েন্ট। ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জে যখন তদানীন্তন বাংলার শ্রমমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দির দেখা হয় মিশন স্কুলের ছাত্র মুজিবের সঙ্গে, তখন আলাপচারিতার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র মুজিবের নাম, ঠিকানা লিখে নেন। পরবর্তীকালে সোহরাওয়ার্দি কলকাতায় এলে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। এর পর তরুণ ছাত্রনেতা হিসেবে মুজিব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং কলকাতায় আসার পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সোহরাওয়ার্দির ডান হাত হয়ে ওঠেন। দুর্ভিক্ষের দিনগুলোয় সোহরাওয়ার্দির লঙ্গরখানা খোলেন। ১৯৪৬ এর কলকাতার ভয়াবহ দাঙ্গার তিক্ত অভিজ্ঞতা তাকে হতাশ করে। এই অভিজ্ঞতা নিয়েই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী দেশনেতা হিসেবে ঢাকার রাজপথে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য করজোড়ে অনুরোধ করেছেন।
আজকের কলকাতায়, বেকার হোস্টেলের বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ২৪ নম্বর ঘরে বছরভর পর্যটকরা আসেন। এই শহরে তার স্মৃতি সত্যি কম নয়। বড্ড অস্থির সময় এই শহরের বাসিন্দা ছিলেন তিনি কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা মুজিবর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পটভূমি তৈরি করেছিল। তাই কলকাতার কাছে সব সময়েই আপন হয়েই থেকে যাবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।