মামুন মুস্তাফা, সাহিত্যিক, বাংলাদেশ
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। আজ থেকে ৭০ বছর আগে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই ঢাকার রাজপথে বীর-বাঙালি রক্ত দিয়েছিল তাঁর মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে। এখন বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয় এই দিনটি। কিন্তু ২১ আন্তর্জাতিকতাকে ছুঁয়ে গেলেও আমার শৈশবের একুশের প্রাণ যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে।
বাবার চাকরিসূত্রে থাকতাম বাংলাদেশের তৎকালীন মহাকুমা শহর বাগেরহাটে (এখন জেলা)। প্রফুল্লচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ের (বর্তমানে সরকারি পি সি কলেজ) শিক্ষক-কোয়ার্টারে থাকার সুবাদে আমরা ভোর হতেই খালি পায়ে একগোছা ফুল হাতে নিয়ে শহিদ বেদিতে উঠে যেতাম। তখন হাড় কাঁপানো শীত ছিল। যদিও বর্তমানে অতি আধুনিক নগরায়ণের ফলে ওই শীতও যেন হারিয়ে গেছে শৈশবের স্বপ্নময় একুশের মতো। আমরা তখন দল বেঁধে কলেজ কোয়ার্টারে বিভিন্ন শিক্ষকদের বাসার ফুলগাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে নিতাম। আমার বাবারই ছিল হরেকরকম ফুলের গাছ। তবে আমাদের হাতে শিউলি ফুলই বেশি থাকতো। তখন ওই বালকবয়সে একুশের বিয়োগান্তক ঘটনা জানা থাকলেও একুশের প্রভাত ফেরি মনের গহিনে আনন্দ-ঢেউ বুনে দিত, গর্বও হতো মাতৃভাষা বাংলার জন্য। কিন্তু তখন আত্মত্যাগকারী শহিদদের জন্য শ্রদ্ধা থাকলেও বেদনার্ত হতাম না।
আজ তাঁদের জন্যে শ্রদ্ধার পাশাপাশি ব্যথা অনুভব করি। ভাষার জন্যে তাঁদের আত্মত্যাগের যথাযথ মূল্যায়ন কি আমরা করতে পারছি? যখন দেখি আধুনিক নগরীর ইংরেজি শিক্ষার ছেলেমেয়েরা টেলিভিশনের পর্দায় একুশ উদযাপন দেখে। আর যাদের শহিদ বেদিতে ফুল দিতে দেখা যায় সেখানে যুবক-যবতী, নানা বয়সি দম্পতি তাদের শিশুদের নিয়ে শহিদ মিনারে ফটো সেশনে ব্যস্ত। ওখানে প্রাণ নেই, থাকে কর্তব্য পালন। সঙ্গে রাজনীতির নানা ক্রিয়া-প্রক্রিয়া। অথচ ভবিষ্যত প্রজন্ম স্বদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে থাকছে; প্রকারন্তরে ঘটছে মেধা পাচার।
এই দায় ও দায়িত্ব অভিভাবকদের, পরিবারের। সন্তানদের ভেতরে দেশপ্রেম জাগ্রত করার জন্যে শুধু টাকা উপার্জনের শিক্ষা না দিয়ে প্রকৃত মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন প্রয়োজন। এখনকার বিদ্যালয়গুলোতে পাঠাগার গড়ে তোলা, বই পড়ার অভ্যাস কিংবা রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী পালন, স্বাধীনতা-বিজয় দিবস পালন সেভাবে চোখে পড়ে না। এখন দেখি এসবের পরিবর্তে ক্লাস পার্টির নামে বিজাতীয় সংস্কৃতির হইহুল্লোর। কার্যত চাকরি বাঁচাতে শিক্ষকরা এমন দিনগুলোতে দায়সারা কাজ করে থাকেন। সুতরাং প্রজন্মের মধ্যে নিজস্ব স্বকীয়তা তৈরি হচ্ছে না। জাগ্রত হচ্ছে না তাঁদের স্বদেশ প্রীতি।
নিজস্বতা যদি নিজেকেই না ছুঁতে পারে, তবে দিবস যতই আন্তর্জাতিকতা পাক, সেটি হবে শুধু লোক দেখানে খোলস মাত্র। আমার শৈশবের একুশকে ফিরে পেতে চাই আমার সন্তানের ভেতরে। আমাদের গৌরবময় বাঙালি সংস্কৃতির জন্যেই প্রয়োজন। আর তার জন্যে প্রয়োজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একুশের তাৎপর্য তুলে ধরে শিক্ষার্থীদের নিয়ে নানাবিধ কার্যক্রমের আয়োজন করা, আনুষ্ঠানিকতা পালন নয়। যা আমাদের শৈশবে আমরা করেছি।