মাসউদ আহমাদ, সাহিত্যিক, বাংলাদেশ
বাংলাদেশে, একুশের প্রথম প্রহরে খালি পায়ে প্রভাতফেরিতে অংশ নেওয়া ও শহিদ মিনারে ফুল দেওয়ার জন্য মানুষের দীর্ঘ সারির ছবি দেখে মন ভরে যায়। দূর থেকে দৃশ্যটা দেখলে মনে হবে কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু এরসঙ্গে মিশে আছে বাঙালির আত্মত্যাগ, অশ্রু ও রক্তের ইতিহাস।
প্রথমে ভাষার অধিকারের দাবিতে ছাত্র ও জনতার মৃদু প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই আন্দোলন শুরু হয়। ক্রমশ সারা পূর্ববাংলায় ছড়িয়ে পড়ে ভাষার জন্য লড়াই ও সংগ্রামের গল্প। সেই গল্পের নেপথ্য ও সামনের সারির যোদ্ধা হলেন আমাদের ভাষাশহিদেরা। প্রভাতফেরিতে অংশ নেওয়া ও শহিদ মিনারে ফুল দেওয়া মানে ভাষা আন্দোলনে শহিদদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানো।
পৃথিবীর সবকিছু ধর্ম, গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক বিবেচনায় দেখা হয়। কিন্তু পূর্বপাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনে, যাঁরা মাতৃভাষার জন্য রক্ত ও প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, এরসঙ্গে বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয় ও আনন্দ আর গর্ব মিশে আছে গভীরভাবে।
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে অপরিসীম শ্রদ্ধা ও আবেগের বিষয়। এটা সার্বভৌম সত্য ও প্রতিষ্ঠিত। ভাষার অধিকারের আন্দোলন ও সাফল্যের সঙ্গে বীরের রক্ত আর মায়ের অশ্রু, দেশবাসীর ভালোবাসা আর চৈতন্য, সংগ্রামশীলতা আর কষ্টস্বীকার মিশে আছে।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার দাবিই ভাষা আন্দোলনের প্রধান দাবি ও লড়াই হলেও এর পেছনে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রশ্ন এবং ওইসব ক্ষেত্রে আশাহত হবার পরিচয় জড়িত ছিল। বলাই বাহুল্য, একুশে ফেব্রুয়ারি জনসাধারণের এই সর্বতোমুখী বিক্ষোভকে রূপ দিয়েছে। সে কারণে ফেব্রুয়ারি মাসটাই হয়ে উঠেছে অবিস্মরণীয় ইতিহাসের।
ভাষা কেবল মানুষের কথা বলার মাধ্যমই নয়, মনের অনুভূতির প্রকাশ ও দাবি আদায়ের হাতিয়ারও। বাংলাদেশে নানা ধর্ম ও জাতির বাস, তবে এখানে প্রধানত বাংলা ভাষাতেই বেশিরভাগ মানুষ কথা বলেন। এটা একইসঙ্গে আনন্দের যেমন, গর্বেরও। ভাষাকে কেন্দ্র করে আমাদের আছে এক অকৃত্রিম আবেগ ও ভালোবাসার সৌধ। ভাষার সঙ্গে প্রতিদিনের জীবনাযাপন, কর্মব্যস্ততা ও ভাবনা মিলেমিশে আছে। আমাদের শিল্প-সাহিত্য-গান, সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য, আমাদের নিজস্বতা ও গৌরবে ভাষা নানাভাবে জুড়ে আছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে, এর নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববাংলা। এই জনপদে নানা ভাষার মানুষ, বিশেষ করে বাংলায় কথা বলার মানুষের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। বিচিত্র ভাষাভাষি মানুষ এখানে বাস করতেন। বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির ভাষার অধিকারকে পদদলিত করে, তাদেরকে রাষ্ট্রের কাজে পূর্ণ অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিকে চেপে রেখে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা হয়। তারই অংশ হিসেবে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত হয়।
প্রাথমিকভাবে ঢাকার অগ্রণী ছাত্রসমাজ ও সংস্কৃতিবান বুদ্ধিজীবীরা ভাষার স্বাতন্ত্র ও অধিকার নিয়ে সচেতনতা প্রকাশ করেন। ক্রমশ সেই চেতনা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত করে। ১৯৪৮ সাল থেকেই এই চেতনা ও সংগ্রামের সূচনা হয়।
পশ্চিম পাকিস্তান যখন উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাইল, সমস্যা ও বিপ্লবের গুঞ্জন সেখান থেকেই। সেই গুঞ্জনই পরবর্তীতে বড় শক্তি ও সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দেয়। বাংলা যেমন হয়ে ওঠে পূর্ববাংলার মানুষের ভাষা, একইসঙ্গে ভাষার আন্দোলনই মুক্তিযুদ্ধের ভীত গড়ে দেয়।
কিন্তু এই সংগ্রাম ও সাফল্য খুব সহজে বা স্বল্প সময়ে সম্ভব হয়নি। মাতৃভাষা বাংলাকে পূর্ববাংলার মানুষের মুখের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। মাতৃভাষার মর্যাদা ও অধিকারের জন্য পূর্ববাংলার নওজোয়ান এবং জনতা রক্ত ও প্রাণ দিতে কুণ্ঠা বোধ করেনি।
ভাষার জন্য রক্ত বিসর্জন ও প্রাণ উৎসর্গ করার ঘটনা পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার এবং পূর্ববাংলার মানুষের একমাত্র ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করতে, ছাত্র ও জনতা যেভাবে অকুতোভয় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অধিকার অর্জন করেছে, এটা বিরল।
ফেব্রুয়ারির প্রথম সকালে যে প্রভাতফেরি হয়, মাসব্যাপী বইমেলার উৎসব হয়, এর সঙ্গে আমাদের আবেগ ও আত্মত্যাগের যোগ আছে।
সে কারণে একুশে ফেব্রুয়ারি সেই অবিস্মরণীয় দিন, সারা পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। জাতিগত অত্যাচারের বিরুদ্ধে, জনতার গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য পৃথিবীব্যাপী মানুষের যুগ যুগ ধরে যে সংগ্রাম ও লড়াই, একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন তাতে যোগ করেছে এক নতুন মাত্রার চেতনা ও বিস্ময়।
বাংলা ভাষায় কথা বলে আমরা ধন্য। এই বাংলায় জন্মগ্রহণ করে ধন্য। ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গিত মহান শহিদদের উদ্দশ্যে শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নিবেদন করতে আমরা আনন্দিত, গর্বিত ও কৃতজ্ঞ।