রণবীর ভট্টাচার্য
থিয়েটার একটি দলগত শিল্প। থিয়েটারে যেমন ব্যক্তি প্রতিভার স্থান রয়েছে আবার দলগত কর্মযজ্ঞের কোনও বিকল্প নেই। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে গিরিশ যুগ, শিশির যুগের পর শম্ভু মিত্র পদার্পণ করেছিলেন এবং অচিরেই হয়ে উঠেছিলেন এক অনন্য যুগচিহ্ন। ব্যক্তি-অভিনেতা কেন্দ্রিক পেশাদারি থিয়েটারের যুগাবসানের পর যে গণনাট্যের যুগ শুরু হয়েছিল, তার অন্যতম পুরোধা ছিলেন শম্ভু মিত্র। আর শম্ভু মিত্র বললেই চলে আসে ‘বহুরূপী’র কথা।
রবিবার বহুরূপীর জন্মদিন। ১৯৫০-এর অস্থির সময়ে বহুরূপীর প্রতিষ্ঠা পরবর্তী সময়কে অনেকেই নবনাট্যের যুগ বলে থাকেন। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে এই সময়টি তাই ভীষণ উল্লেখযোগ্য হয়ে থেকে গিয়েছে।
বহুরূপীর গঠনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ভেঙে যাওয়ার ইতিহাস। শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্যের মতো বিশিষ্ট থিয়েটার ব্যক্তিত্ব ১৯৪৮ বহুরূপী প্রতিষ্ঠা করেন। পঞ্চাশের দশকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নাটক মঞ্চস্থ করে এই দল। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’, ‘রক্তকরবী’র সঙ্গে ইবসেনের ‘ডলস হাউস’-এর নাট্য রূপায়ণ ‘পুতুলখেলা’ আলোড়ন তুলেছিল তৎকালীন নাট্যসমাজে। এরপর ‘বিসর্জন’, ‘দশচক্র’, ‘রাজা অয়দিপাউস’, ‘রাজা’, ‘চুপ! আদালত চলছে’, ‘ডাকঘর’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘গ্যালিলিও’ অচিরেই তৈরি করে ফেলে অনেক গুণমুগ্ধ।
শম্ভু মিত্র ও বহুরূপীর কথা বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’র মঞ্চায়নের কথা উঠে আসবেই। ভুললে চলবে না যে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ‘রক্তকরবী’র মঞ্চায়ন হয়নি। বাংলা থিয়েটার জগতে অভিনয়, দৃশ্য রচনা, নাট্য আবহ রচনা, প্রয়োগ ভাবনার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিল বহুরূপীর তথা শম্ভু মিত্রের ‘রক্তকরবী’।
১৯৭৮ সালে এই বহুরূপীর সঙ্গেই শম্ভু মিত্রের বিচ্ছেদ হয়। শম্ভু মিত্র পরবর্তী সময়ে কুমার রায়ের আমলে এগিয়ে চলে বহুরূপী এবং নিঃসন্দেহে দেশের অন্যতম পুরনো থিয়েটার দল হিসাবে এখনও নাটক প্রযোজনা করে চলেছে।
এই বছরের প্রখ্যাত নাট্যকার তথা শম্ভু মিত্রের কন্যা তৃপ্তি মিত্রের জীবনাবসানের মধ্যে দিয়ে এক যুগের অবসান হয় বহুরূপীর। তবে নাটক এগিয়ে চলেছে, সঙ্গে বহুরূপীও। বহুরূপী পথ দেখিয়েছে সমসাময়িক অনেক নাট্যদলকেও। তাই বয়সের ভরে ক্লান্ত হয়নি বহুরূপী, বরং কচিকাচার দল নিয়ে মঞ্চে নিয়ে এসেছে সমাজকে, বারবার, বিভিন্ন পোশাকে, বিভিন্ন আঙ্গিকে। আর রয়ে গিয়েছে সেই আদর্শ।
বেঁচে থাক বহুরূপী, বেঁচে থাক বাংলা থিয়েটার জগৎ।