সম্প্রতি কবি সুধীর দত্তকে নিয়ে আয়োজিত হল এক বিশেষ সন্ধ্যা। সুধীর সেভাবে মিডিয়া চর্চিত নাম নন। আর সেখানেই তাঁর অনন্যতা। জনতার স্রোতে ভেসে যায় না তাঁর কবিতা। বরং দাবি রাখে গভীর দৃষ্টিকোণের। পাশাপাশি ব্যাপক পাঠ-অভিজ্ঞতার। সমাজ, রাজনীতি ছুঁয়ে তাঁর কবিতা পৌঁছায় বৃহত্তর অর্থে। কিন্তু সে কবিতার গভীরে গেলে তল পাওয়া সহজ নয়। কারণ তাঁর লেখায় সহবাস করে সমসময় আর মহাসময়।
অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল কবি রামচন্দ্র প্রামাণিকের সঙ্গে। এইচটি বাংলাকে তিনি জানালেন, কেন সুধীর এখনও প্রাসঙ্গিক। প্রথমে নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন তিনি। ‘কোনও এক অনুষ্ঠানে এক বক্তা বলেছিলেন, সুধীরকে বোঝা দুরূহ। বেশিরভাগ কবিতাই পুরাণ-জর্জরিত। কিন্তু পড়তে ভালো লাগে। তার পর ছিল আমার বলার পালা। আমি সুধীরের কবিতা কোট করেই দেখিয়ে দিই কেন ও প্রাসঙ্গিক। ওর ‘দেবতা লিখিত কাব্য’-এ উঠে এসেছে আনন্দমার্গীদের পুড়িয়ে মারার ভয়াবহ স্মৃতিদাগ। অভিযোগ, এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ১৯৮২ সালের তৎকালীন শাসক ফ্রন্ট।’
‘তিন দশক পরেও এই যে
বিজনসেতুর মুখে পেট্রোলে দগ্ধানো ক্ষতদাগ
ধোওয়া যায়নি,
দেবতা-লিখিত হা-হা? ….’
রামচন্দ্রবাবুর কথায়, ‘পাঠের পরিধি ব্যাপক না হলে সুধীরকে বোঝা দূরূহ। পুরাণ ও অন্য প্রসঙ্গ কবিতা জুড়ে থাকে বলেই তা বুঝতে সম্যক জ্ঞান দরকার। সুধীরের পাঠক সীমিত। কিন্তু ওর কবিতা ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। সমাজ, যৌনতা, রাজনীতি সবই তাঁর লেখায় উঠে আসে।’
সংবাদ জগতে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন অনুষ্ঠানের অন্যতম বক্তা শোভন তরফদার। লিটল ম্যাগাজিন ঘরানার বাইরে সুধীর লেখা শুরু করেন তাঁর অনুরোধেই। তখনও আনন্দ পুরষ্কার অনেক দূরে। শোভনবাবু জানালেন সুধীরবাবুর স্বাতন্ত্র্যের কথা। ‘তিনি কাব্যের বিষয়ে ও প্রকরণে ধ্রুপদী ভঙ্গিমার অন্বেষণ করেন। দেশ-বিদেশের নানা মিথ এবং ভারতের দু’টি এপিক, বিশেষত মহাভারতের অনুষঙ্গ ফিরে ফিরে আসে তাঁর লেখায়। সেই অর্থে এই কবি যেন এক মহাকাব্যিক কথক।’ আক্ষরিক অর্থেই ‘মহাকাব্যিক’ বোঝাতে চান শোভন তরফদার।
বিশিষ্ট গায়ক তথা অনুষ্ঠানের অন্যতম বক্তা প্রতুল মুখোপাধ্যায় জানান, ‘একটা সময় পর্যন্ত সুধীর দত্তের কবিতার সঙ্গে আমার সেভাবে পরিচয় ছিল না। এক অনুষ্ঠান সূত্রে সুধীরের একটি কবিতাকে লোকসঙ্গীতের সুর দিয়ে পরিবেশন করি।’ সেই থেকে পরিচয়ের শুরু। প্রসঙ্গত, ‘হ্রেষা ও ক্ষুরধ্বনি’ কাব্যের প্রথম কবিতা ছিল সেটা। সেই গান শুনে কবির কী প্রতিক্রিয়া হয়? ‘পর দিন সকালে কবি ফোন করে ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলেন। বললেন, উনি যেভাবে ভেবেছেন কবিতাটা, ঠিক সেই সুরই নাকি ফুটে উঠেছিল আমার গানে। এটা সত্যি আমার ভালো লাগার জায়গা।’ জানালেন প্রতুলবাবু।
এই দেশ বা ওই দেশের পুরাণ বলে হয়তো নয়। সবটাকেই হয়তো এক ‘দেশ’ করে সময় বরাবর হাঁটেন সুধীর। তাই যম-যমী অ্যাখ্যানের পাশেই এসে দাঁড়ায় অয়দিপাউস কমপ্লেক্স। আত্মীয়-যৌনতা। সময় ও তলের ভূমিকা তাঁর কবিতায় অনেক।
‘একটি, দুটি— দেখতে দেখতে সব কটি তারা
আমাকে জড়িয়ে ধরে: চল।
আর নীচে মাটি ও গুল্ম— কোয়ান্টাম লাফ
পার হই সমুদ্রজল, অভিকর্ষ
একে একে যৌনতা ও সশস্ত্র বিপ্লব।’
‘তাঁবু, মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছ’ সহ নানা কাব্যে এভাবেই ধরা দেয় সুধীরের মহাজগত-প্রেম। এই ব্যতিক্রমী প্রেম বাংলার কাব্যে শেষ কবে এসেছে? অতিপরিচিত বাঙালি কবিদের কথাই যদি ভাবা হয়? প্রথমেই মনে পড়তে পারে জীবনানন্দ দাশকে। কবি গীতা চট্টোপাধ্যায় এক প্রবন্ধে লেখেন, ‘জীবনানন্দের বৃত্তকে যেন সম্পূর্ণ করেন সুধীর।’ জীবনানন্দের মতোই অনেকটা আড়ালে অবস্থান তাঁর। হয়তো আকাঙ্খা এই— পাঠক তাঁর কাছে মনের গভীর তৃপ্তি পেতে আসুক। অগভীরে যেন শেষ না হয় কবির সঙ্গে পরিচিতি।