রণবীর ভট্টাচার্য
ভারত আজ পেরিয়ে এসেছে অনেকটা রাস্তা। এই এগিয়ে চলার রাস্তায় কখনো বিদেশি শক্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে, আবার কখনও দরকার হয়ে পড়েছে সমাজ সংস্কারের। এই দীর্ঘ পথ জুড়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন মনীষীরা, যারা সমস্ত সমালোচনা অবজ্ঞা করে দেশকে ভালোবেসে আত্মত্যাগ আর আদর্শের পথে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। ঠিক এই রকম একজন মানুষের শুক্রবার, ২০ মে ২৫০তম জন্মবার্ষিকী। হ্যাঁ, রাজা রামমোহন রায় একজনই ছিলেন যার প্রদর্শিত পথে দেশ দেখেছিল পরিবর্তনের হাওয়া। আজও আমাদের সমাজ নতমস্তকে কৃতজ্ঞ তার কাছে। সাহিত্য, ধর্ম, শিক্ষা বিজ্ঞান, সমাজ নীতি, রাষ্ট্রনীতি— সর্বত্রই আপামর ভারতবাসীকে আধুনিকতার পাঠ দিয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়। যেই মানুষকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারত পথিক বলেছিলেন, তাকে আধুনিক ভারতের জনক বলার মধ্যে কোন অত্যুক্তি নেই!
গত ২৫০ বছরে দেশ বদলেছে অনেকটাই। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ভারত আজ স্বাধীন। আজকের ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার বুনিয়াদের উপর দাঁড়িয়ে। তাই গণিত, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, রসায়ন, সমাজ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, পদার্থ বিদ্যার সহাবস্থান রয়েছে ভারতের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহের রাস্তা ছেড়ে ভারত আজ আধুনিক। সতীদাহ আজ স্রেফ অন্ধকার অতীত। ১৮২৯ সালের ৪ই ডিসেম্বর যেদিন গভর্নর জেনারেল বেন্টিং আইনের মাধ্যমে সতীদাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, সেদিন শুরু হয় ভারতীয় সমাজে এক নতুন অধ্যায়। আজ দেশের প্রতিটি স্তরেই সমাজ সসম্মানে নারীরা ভূষিত। দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নারী, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও বিভিন্ন রাজ্যে মহীয়সী নারীরা রয়েছেন। ভারতের প্রথম সংবাদপত্রের সাথেও সরাসরি যোগাযোগ ছিল রাজা রামমোহন রায়ের। তাই এই দেশ ও দশ শুধু কৃতজ্ঞ নয়, বরং তাঁর দেখানো পথেই এগিয়ে যাবে সামনের দিনে।
তবে রাজা রামমোহন রায়ের প্রাসঙ্গিকতা কিন্তু এতটুকু কমেনি বর্তমান ভারতে। আজও সমাজে রয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে হিংসা হানাহানি, নারী সুরক্ষা আজও প্রশ্নের মুখে এবং ভারতে আজও প্রতিদিন স্রেফ পণের দাবির মুখে অত্যাচারের মুখোমুখি হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়তে হয় মেয়েদের। শিক্ষা আজ স্রেফ ডিগ্রি অর্জন করার পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সত্যিকারের শিক্ষা আজ কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নৈতিকতার ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ভারতীয় সমাজকে এক অদ্ভুত সংকটের সামনে এসে দাঁড় করিয়েছে। নিঃসন্দেহে ভারতের এক নব্য নবজাগরণের প্রয়োজন, যেখানে সমাজের দোষ ত্রুটিগুলো প্রশ্ন করা হবে, উলঙ্গ রাজার সভায় সেই বাচ্চাটিকে খুঁজে পাওয়া যাবে আর অবশ্যই ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে।
রাজা রামমোহন রায়ের নামে আজ স্কুল রয়েছে, লাইব্রেরী রয়েছে এবং অনেক প্রতিষ্ঠান ও আছে। কিন্তু কতজন ওই বরেণ্য মানুষের আদর্শ মেনে চলেন? রাজা রামমোহন রায়ের আত্মত্যাগ কি বিফলে চলে যাবে? রাজা রামমোহন রায়ের জাতীয়তাবাদ কেন নতুন করে চর্চা করা হবে না?
আজ এই ২৫০তম জন্মবার্ষিকীর প্রাক্কালে প্রশ্নগুলো সমাজের সকল সুস্থ মানুষকে ভাবতেই হবে।