এই বছর সত্যি বড় অদ্ভুত! একদিকে দেবী সরস্বতীর আরাধনা আর অন্য দিকে কবি শঙ্খ ঘোষের জন্মদিন। এই বছর এমনই একটি জন্মদিন, যেখানে কবি পরলোকে ব্যস্ত রয়েছেন সাহিত্যচর্চায়। শঙ্খ ঘোষের মূল্যায়ন শুধু তার কবিতায় নয়, বরং তার চিন্তন, মননশীল কাজে এবং অবশ্যই সমাজচেতনায়। এক অক্লান্ত কবি যিনি প্রতিবাদে কখনও পিছিয়ে পড়েননি, কলম এগিয়ে চলেছে তার রুদ্ধ সঙ্গীতে, তাই এখনও বারবার শরনাপন্ন হতে হয় তার কবিতায়, একটু শান্তির জন্য।
স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৫৩ সালে প্রথম কবিতা প্রকাশ এবং ১৯৫৬ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ দিনগুলি রাতগুলি। ‘বাবরের প্রার্থনা’ হোক কিংবা ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’— পদ্মভূষণ ও জ্ঞানপীঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ছিলেন ‘পঞ্চপান্ডব’-এর অন্যতম এক কুশীলব।
হাংরি জেনারেশনের সমসাময়িক হয়েও স্বতন্ত্র ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। প্রেম বিরহের সাধারণ ছন্দের মধ্যে তিনি থাকেননি, বরং নাগরিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ওঁঁর প্রতিটি ছত্রে দেখা গিয়েছে। তিনি কি কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ উত্তরসূরি ছিলেন? এর সঠিক বা ভুল উত্তর নেই। তবে জীবনানন্দ দাসের মতো রূপকের ব্যবহারে পারদর্শী ছিলেন আবার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো অবাক করে দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও লেখনীতে সংযত থেকেছেন। কবিতায় নিজেকে, নিজের লেখার বুনোটকে বারবার ভাঙ্গাগড়া করেছেন। প্রকৃতি অনেক বার ঘুরে ফিরে এসেছে ওঁর কলমে— আগুন, জল, পৃথিবী, প্রাণী, গাছ... কী নেই সেখানে!
বঙ্গে এক সময় বুদ্ধিজীবী আর বুদ্ধজীবী নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল। তার এক দশক পেরিয়েও বিতর্ক চলতে থেকেছে সুশীলসমাজ নিয়ে। খুব সম্প্রতি পদ্মশ্রী বিতর্ক আরও একবার আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে বাঙালি মননে কোথায় চিড় ধরেছে। সেখানেও অনন্য ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। ইংরেজিতে 'টাইমলেস' কথাটা অনেকেই বারবার বলে থাকেন। বাংলায় কাছাকাছি শব্দ বলতে কালজয়ী। তবে শঙ্খ ঘোষের কবিতা বোধহয় এসবের ঊর্ধ্বে। অনেকেই পরবর্তীকালে কবির রাজনৈতিক চেতনা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। তবে আর যাই হোক, কবি কোন পদের সুপ্ত ইচ্ছায় বিবেক ভাড়া দেননি। কোভিডে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত শিরদাঁড়া সোজা রেখেছেন। এই জন্য বোধহয় দেবী বন্দনার দিনে তিনি আবারও ফিরে এসেছেন, তার কবিতায়, তার ভাবনায় এবং অবশ্যই ঐতিহ্যে।