স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন দিল্লির রাজপথে কুচকাওয়াজ তথা সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর প্যারেড অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ সমগ্র দেশবাসীর জন্য। ১৯৫০ সালে প্রথমবার হয় এই বিশেষ কুচকাওয়াজ এবং দেশ বিদেশের মানুষ গণমাধ্যমে প্রতি বছর এই বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রতিটি মুহূর্ত দেখেন। এই বিশেষ কুচকাওয়াজ রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে শুরু হয়ে রাজপথ এবং ইন্ডিয়া গেট পেরিয়ে লালকেল্লা পৌঁছোয়। সেখানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন মাননীয় রাষ্ট্রপতি।
প্রতি বছরই কোন না কোন বিদেশি রাষ্ট্রনায়ক বিশেষ অতিথি হয়ে উপস্থিত থাকেন। ১৯৫০ সালের কুচকাওয়াজে তৎকালীন ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি সুকর্ণ বিশেষ অতিথি হয়ে এসেছিলেন। সমগ্র কুচকাওয়াজে দেশের সামরিক বিভাগের স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী ও বায়ুসেনা একে একে এগিয়ে চলে বাদ্যযন্ত্রের তালে তাল মিলিয়ে। এর সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলে বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সুসজ্জিত ট্যাবলো। যা স্থানীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন আঙ্গিক তুলে ধরে। প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি হয় ২৯ জানুয়ারি বিটিং রিট্রিটের মাধ্যমে। ভারত সরকারের তরফে পুরো অনুষ্ঠানটির আয়োজনে থাকে কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
এই বছর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রস্তাবিত নেতাজির স্মৃতি বিজড়িত ট্যাবলোর প্রস্তাব গৃহীত হয়নি কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে। বিষয়টি রাজনৈতিক মাত্রা পেয়েছে অনেকটাই এবং বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন। এই ট্যাবলো বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়া কিন্তু নেহাৎ কয়েক দিনের নয়, বরং প্রতি বছর একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। এরকম কোনও বাধ্যবাধকতা নেই যে সব রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে ট্যাবলোর মাধ্যমে।
প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ট্যাবলো বেছে নেওয়ার জন্য রয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। এই বিশেষজ্ঞ কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন শিল্প, সংস্কৃতি, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সঙ্গীত, স্থাপত্য, নৃত্যকলা এবং অন্যান্য বিভাগের কৃতী মানুষজন। এই বিশেষ কমিটি বিভিন্ন প্রস্তাব বেছে নেওয়ার আগে দেখে থিম, ধারণা, নকশা এবং ভিজুয়্যাল। প্রথম পর্যায়ে ট্যাবলোর যে প্রস্তাব বেছে নেওয়া হয়, সেখানে প্রয়োজন পড়লে কিছু পরিবর্তনের কথা বলা হয় বিশেষজ্ঞ কমিটির তরফে। এর পরে নকশা অনুমোদনের পর ত্রি-মাত্রিক মডেল দেওয়ার কথা বলা হয়। তবে এই স্তরে পৌঁছনোর মানে যে ট্যাবলোর অনুমোদন পাওয়া গেল, এমন নয়। বিভিন্ন দিক ভাবনা চিন্তার পর শেষমেশ বেছে নেওয়া হয় প্রজাতন্ত্র দিবসে অংশগ্রহণ করবে কোন কোন ট্যাবলো।
গত কয়েক বছরে আধুনিকতার প্রভাব পড়েছে ট্যাবলোর মধ্যেও। শুধুমাত্র প্রকৃতি, পরিবেশ সংরক্ষণ বা সবুজায়নের মত বিষয় নয়, তার সঙ্গে রোবট, ভার্চুয়াল বাস্তবতা ব্যবহারের দিকটিও উঠে এসেছে। নিয়মানুযায়ী ট্যাবলোপিছু ট্রাক্টর ও ট্রেলরের মধ্যে ৬ ফিট দূরত্ব রাখতে হবে। ট্রাক্টর ২৪ ফুটের মধ্যে হতে হবে। ট্রেলার সব মিলিয়ে ১০ টনের জিনিস বহন করতে পারবে। কোনও রাজ্য চাইলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দেওয়া ট্রাক্টর-ট্রেলার ব্যবহার না করে নিজেদের গাড়ি ব্যবহার করতে পারে। তবে কোনও অবস্থাতেই ট্যাবলো ১৬ ফিট উচ্চতা, লম্বায় ৪৫ ফিট এবং চওড়ায় ১৪ ফিট অতিক্রম করবে না।
২০২২ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের জন্য ৩৬টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, ৮০টি কেন্দ্রীয় মন্ত্রক, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন, নীতি আয়োগকে চিঠি পাঠানো হয়েছিল ১৬ই সেপ্টেম্বর, ২০২১। এই চিঠিতে থিম হিসেবে জানানো হয়েছিল ভারত @৭৫ - স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাবনা @৭৫, কর্ম @৭৫ এবং সমাধান @৭৫ - সমস্ত ভাবনাই ভারতের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে। শেষমেষ এই বছর প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ উপলক্ষ্যে বেছে নেওয়া হয়েছে ২১টি ট্যাবলো। যেখানে ১২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বের সঙ্গে থাকবে ৯টি কেন্দ্রীয় মন্ত্রকও। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে মেঘালয়ের ট্যাবলো রাজ্যের পঞ্চাশ বছর হওয়ার দিকটি তুলে ধরবে। একাধারে কর্ণাটক যেমন হস্তশিল্প তুলে ধরবে, আবার হরিয়ানা সেখানে কীভাবে খেলাধুলায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সম্মান এনেছে, সেটা তুলে ধরবে। তবে একথা ঠিকই যে তুলনামূলক বিচার অনেক সময়ই বিতর্ক ডেকে আনে, তবে সব রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে সুযোগ দেওয়া বাস্তবে সম্ভব নয়। তবে স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদ্যাপনের বছরে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ন।