আমি একুশে ফেব্রুয়ারিতে একবার ঢাকায় ছিলাম। শহিদ বেদিতে মালা দিয়েছি। সেখানকার পাঠকেরা আমাকে সুন্দর সুন্দর পাঞ্জাবি উপহার দিয়েছিলেন। সেই পাঞ্জাবির বুকে পিঠে সর্বত্র লেখা ছিল ভাষা দিবস। পাঞ্জাবিটি যত্ন করে রেখেছি। মাঝেমধ্যে পরে ঘুরে বেড়াই। লোকে অবাক হয়ে দেখে। বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার উচ্চ ধারণা আছে এই কারণে, ওঁরা বাংলা ভাষাটাকে সত্যিই ভালোবাসে। বাংলায় চিন্তা করে। আমি গিয়ে দেখলাম, ওঁরা সত্যি সত্যি বাঙালি! ওঁদের শিল্পচর্চা, লেখায় কখনও ইংরেজি শব্দ ঢুকে পড়ে না। নিষ্ঠা ছাড়া এ তো সম্ভব না।
আমাদের এই পার্শ্ববর্তী রাজ্যটি, যা এক সময় অখণ্ড বাংলারই অংশ ছিল। ওঁদের ভূমি আমাদের ভূমি সব একাকার ছিল। কে যেন হঠাৎ মাঝখান থেকে চিরে দিয়েছে! এসব এখান ইতিহাস। বাঙালি বাংলা ভাষায় কথা বলবে। ইংরেজিও শিখতে পারেন। আরও সত্তরটা ভাষা শিখতে পারেন। আমাদের এখানে যাঁরা ভাষাবিদ তাঁরা তো অনেক ভাষাই জানেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হল আমি যাদি বাংলায় আমার মনে ভাব প্রকাশ করতে না পারি, মা বলে ডাকতে না পারি, বাবা না বলতে পারি-- তাহলে তো আমার কাছে আমিই একজন ফরেনার। এটা আমার নিজস্ব ধারণা।
আমারা মাতৃগর্ভে দশ মাস থাকি। সেই সময়ই কোনও অদৃশ্য শক্তি আমাদের বর্ণমালার ছকটি মাথায় বসিয়ে দিয়ে যান। আমারা ভূমিষ্ঠ হই, কিছুক্ষণ কান্নাকাটির পর মা বাবা বলতে শুরু করি। বাঙালির ছেলে বাংলা বলে, ইংরেজের ছেলে ইংরেজি বলে, ফরাসি দেশের ছেলে ফরাসি ভাষা বলে-- এটা মাতৃগর্ভের একটা বিস্ময়কর গুণ। আমি কোন ভাষায় কথা বলব সেটা আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। এই রহস্যের তো কোনও সমাধান নেই।
প্রত্যেকটি জাতির, প্রত্যেকটি ভাষাভাষির মানুষের একটা নিজস্ব মাতৃভাষা থকে। বাংলাদেশে যে আন্দলোনটি হয়েছিল, সেটি আরেকবার চোখে আঙুল দেখিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে দেখিয়ে দিয়েদিল-- জোর করে স্বাধীনতা হরণ করা যায়, চেন দিয়ে বেঁধে কারাগারে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু কণ্ঠ থেকে মাতৃভাষাকে কিছুতেই কেড়ে নেওয়া যায় না।