শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
ছোটবেলা থেকেই আমি হোস্টেল-বোর্ডিংয়ে মানুষ হয়েছি। সেই সময় পুজোর ছুটিতে বাড়িতে যেতাম মায়ের কাছে। মায়ের কাছে থাকাটাই আমার কাছে উৎসব। মা-ই ছিল আমার কাছে কালী বা দুর্গা মা। মায়ের কাছে থাকার যে আনন্দ সেটা আমি বলে বোঝাতে পারব না। মা-ও আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকত। ভাইবোনও অপেক্ষা করত, কারণ আমি গেলে খুব আনন্দ হত। কালীপুজোয় কিংবা ভূত চতুর্দশীতে চোদ্দ শাক খাওয়ার একটা নিয়ম আছে। সেই নিয়ম আমাদের পূর্ববঙ্গের বাড়ি থেকেই চলে আসছে। চোদ্দ রকম শাক কিনে আনতাম। চোদ্দ বাতি দিতাম। তখন টুনি বাল্বের চল ছিল না। বাড়িতে মোমবাতি ও তেলের প্রদীপ জ্বালানো হত। এই সময় উত্তরের বাতাস আসে। উত্তরবঙ্গেই আমাদের বাড়ি ছিল। বাতাসে বাতি নিভে গেলে আবার জ্বালিয়ে দিতাম। সব মিলিয়ে ভূত চতুর্দশী আমার কাছে চূড়ান্ত আনন্দের দিন।
অনেকে বলত এই দিনে নাকি আঁশটে গন্ধ পাওয়া যায় বাতাসে! অর্থাৎ ভূতের গায়ের গন্ধ। ভূতের গায়ের আদৌ কোনও গন্ধ আছে কিনা আমার জানা নেই। আমি কোনও দিন সেই গন্ধ পাইনি। কিন্তু এরকম কথাবার্তা প্রচলিত ছিল সেই সময়। আমি ভূতে বিশ্বাস করি। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সব কিছু শেষ হয়ে যায় না। মৃত্যুর পরেও মানুষের অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবেই থাকে। আমি তার প্রমাণ অনেকবার পেয়েছি। সেসব কথা আজ থাক।
বরং বলি, ভূত ভতুর্দশী আমার খুব প্রিয় একটা দিন। এই দিনে মায়ের কাছে থাকতাম। ভাই বোন আমার সঙ্গে ঘুরত। তাই এই দিনটা খুব আনন্দের দিন আমার কাছে। কালীপুজোতেও খুব আনন্দ হত। তারাবাতি, পটকা ফাটাতাম। আজকের ভূত চতুর্দশীতেও আমার বাড়িতে চোদ্দ শাক রান্না হয়েছে। বাজার থেকে চোদ্দ রকম শাক আনিয়েছি। সব মিলিয়ে মিশিয়ে দিনটাকে উপভোগ করি। এখন অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। কিন্তু মায়ের স্মৃতি আছে। আজকের দিনে মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। চার ভাইবোনের মধ্যে আমি একা বেঁচে আছি। ওঁদের কথা মনে পড়ে। ওঁরা যখন ছোট ছিল আমার ওপর নির্ভর করত। আমার ফেরাটা ওঁদের কাছে একটা উৎসব। আমি বাড়িতে না গেলে পুজোটাই ওঁদের কাছে ফিকে হয়ে যেত। আমি হোস্টেল থেকে ফিরব তার জন্য অপেক্ষা করত। বাড়িতে গেলে সারাদিন আমার সঙ্গে লেগে থাকত। কাটিহার, মাল জংশন, দোমহনি, লামডিং, বদরপুর, আলিপুরদুয়ার-- এতগুলো যায়গায় আমরা থেকেছি। বাবা শেষ জীবনে শিলিগুড়িতে বাড়ি করেছিলেন। পূর্ববঙ্গের পর আমাদের প্রথম বাড়ি হল শিলিগুড়িতে।
কালীপুজোয় আমাদের বাড়িতে টুনি লাইট জ্বললেও এখনও মোমবাতি জ্বালানোর প্রথা আছে। এখনকার ভূত চতুর্দশী অন্যরকম ভাবে কাটে। নাতনির বয়স ৯ বছর। ও এখন কিছু কিছু বাজি ফাটাতে পারে। এখন কালীপুজোয় ঘরে ঘরে বাতি জ্বলে। তাই ভূতের ভয়ের পরিবেশ থাকে না।