চর্চার নয়া খোরাক পেয়েছে বঙ্গবাসী— সেক্স টয়। অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকা, গয়নার সঙ্গে ‘উদ্ধার’ হয়েছে সেই বস্তুটিও। তাও আবার একটি নয়, দু’টি!
ব্যস, এর পর দুর্নীতি-টুর্নীতি অতীত! আপাতত আলোচনার কেন্দ্রে অর্পিতার যৌনজীবন। আর তা নিয়ে নেটমাধ্যমে যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া ট্রোল-মিমের বন্যা। সেই সুবাদে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সমীকরণ নিয়ে চলতে থাকা জলঘোলাও পেল নতুন দিশা। উঠে এল অজস্র প্রশ্ন— কেন সেক্স টয় পাওয়া গেল অর্পিতার কাছে? সেগুলি দিয়ে কী-ই বা করতেন তিনি? যদিও ওই ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া গেলেও, সেগুলি আদৌ অর্পিতারই কি না, তা এখনও খাতায়-কলমে কোথাও দাবি করা হয়নি।
কেউ কেউ ধরেই নিয়েছেন এবং চটুল রসিকতার মাধ্যমে দাবি করে ফেলেছেন, ওই বস্তু দু’টি আসলে পার্থবাবুর ‘অক্ষমতা’র জ্বলন্ত প্রমাণ। ফেসবুক-টুইটারে এহেন তত্ত্ব-গবেষণার ছড়াছড়ি। ধরে নেওয়াই হয়েছে, সঙ্গীর ব্যর্থতার কারণেই সেক্স টয়ের সাহায্য নিয়েছেন অর্পিতা।
পার্থর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। তার ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া গিয়েছে কোটি কোটি টাকা। তাঁদের নিয়ে চর্চা হওয়া তো সত্যিই অস্বাভাবিক কিছু নয়! কিন্তু দু'জনের যৌনজীবন এবং সেখানে সেক্স টয়ের ভূমিকা নিয়ে এই রগরগে আলোচনা কতটা যুক্তিযুক্ত?
এ বিষয়ে সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক এবং জেন্ডার স্টাডিজের গবেষক সমতা বিশ্বাস বলেন, ‘এই মহিলা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। যাঁকে জড়িয়ে এত কথা হচ্ছে, তিনি আদৌ তাঁর সঙ্গী কি না, তাও এখনও কারও জানা নেই। আমরা ধরেই নিচ্ছি যে, যৌনসুখ শুধুমাত্র সঙ্গীর যৌনাঙ্গের উপরেই নির্ভরশীল। আর কোনও ভাবেই তা পাওয়া যেতে পারে না।’
এ বার প্রশ্ন ওঠে, নারীর যৌন স্বাধীনতা কি এখনও সোনার পাথর বাটি? যৌন সুখের জন্য কি তাঁরা শুধুমাত্র সঙ্গীর উপরেই নির্ভরশীল?
সমতার মতে, যৌনসুখের জন্য নারীরা অন্য কারও উপর নির্ভরশীল নাও হতে পারেন। কিন্তু বর্তমান সমাজব্যবস্থায় গুরুত্ব পায় না নারীর যৌন স্বাধীনতা। তাঁর কথায়, ‘একজন মেয়ে সেক্স টয় ব্যবহার করলে, তা নিয়ে ব্যঙ্গ করে তাঁর দৈহিক ও যৌন স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়। মনে করা হয়, তিনি শুধুমাত্র পুরুষের সঙ্গেই সঙ্গম করবেন। আমরা ভাবতেই পারি না, নিজেদের সিদ্ধান্ত মেয়েরা নিজে নেবেন। ঠিক সেভাবেই মনে করা হয়, তাঁদের যৌনতাও পুরুষরা নিয়ন্ত্রণ করবেন। কেউ তার বাইরে গেলেই তা নিয়ে হাসিঠাট্টা হয়।’
সুস্থ জীবনযাপনের জন্য খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো স্বাস্থ্যকর যৌনজীবনও গুরুত্বপূর্ণ। এমনটাই মনে করেন মনোচিকিৎসক সঞ্জয় গর্গ। তাঁর কথায়, ‘আমাদের প্রত্যেকেরই যৌন চাহিদা আছে। আর সেটা লুকনো যায় না। কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা নিয়ে বেশি আলোচনা হয়। ছেলেরা কিছু করলে, তা নিয়ে চর্চা হয় না। মেয়েরা করলেই নিন্দা। এটা আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সমস্যা।’
অসমবয়সী রসায়নের দিকটিও তুলে ধরেছেন চিকিৎসক। তাঁর মতে, কেউ কেউ সম্পর্কে জড়ান সম্পূর্ণ মানসিক কারণে। সেক্ষেত্রে বয়সের বিরাট পার্থক্য বা যৌনতা প্রাধান্য পায় না। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাঁধাধরা নিয়মের বাইরে গেলেই কটাক্ষের শিকার হতে হয় নানা ক্ষেত্রে।
সঞ্জয় জানান, যৌনজীবনকে অন্য মাত্রা দিতে ইদানীং অনেকেই সেক্স টয় ব্যবহার করেন। এতে একঘেয়েমি কাটে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে তো রোজ রান্না হয়। কিন্তু তাও আমরা মাঝেমধ্যেই রেস্তরাঁয় খেতে যাই। কারণ সেখানকার খাবার, পরিবেশ একদম অন্য রকম। আমাদের মধ্যে ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। সেক্স টয়ের বিষয়টাও খানিক সে রকম। নতুনত্বের স্বাদ এনে দেয়।’
সঙ্গী থাকা সত্ত্বেও নারীরা যৌনভাবে স্বাধীন হতে পারেন? প্রশ্ন রাখা হয়েছিল যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গোবিন্দ গুপ্তের কাছে। তাঁর বক্তব্য, যে কোনও মানুষের ক্ষেত্রেই যৌন স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যকর যৌনজীবন শরীর এবং মনের উপরেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ট্রোল-কটাক্ষের পাশাপাশি সেক্স টয় নিয়ে নানাজনের নানা কৌতূহল। আদৌ কি এটি ব্যবহার করা ঠিক? এ ধরনের কোনও বস্তু কাছে রাখলে কি কোনও আইনি জটিলতা হতে পারে? গোবিন্দ বলেন, ‘যাঁরা একা বা বিবাহবিচ্ছিন্ন, তাঁরা অনেকেই এটি ব্যবহার করেন। সঙ্গী থাকলেও এটি ব্যবহার করতে বাধা নেই। অনেক সময় সঙ্গমের থেকেও বেশি যৌনসুখ দেয় সেক্স টয়।’
তাঁর সংযোজন, ‘সেক্স টয়ের ব্যবহার যেমন আইনি মর্যাদা পায়নি, তেমনই এটি বেআইনিও নয়। বিষয়টি এখনও ধূসর। কেউ যদি বিমানবন্দর থেকে এটি নিয়ে আসেন, তাঁকে কিন্তু গ্রেফতার করা যাবে না। আইনিভাবে এর আমদানি এখনও সম্ভব নয় ঠিকই, তবে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য এটিকে বাড়িতে রাখা যেতেই পারে।’
টানা দু'দিন ধরে এই সেক্স টয় নামক বস্তুটিকে নিয়ে অক্লান্ত কাটাছেঁড়া চলছে। কোথাও গান বাঁধা হচ্ছে, তো কোথাও আবার ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লেখার ধুম! যেন মহাজাগতিক কোনও বস্তুর সন্ধান মিলেছে! বিস্ময়ের ঘোর তাই কাটছে না। কিন্তু দুর্নীতির সঙ্গে অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়া সেক্স টয়গুলির সম্পর্কটা ঠিক কোথায়? কেনই বা সেগুলি কোটি কোটি টাকা, গয়নার সমান গুরুত্ব পাচ্ছে? কারও ব্যক্তিজীবন নিয়ে এই টানাটানিই বা কতটা সমর্থনযোগ্য? যাবতীয় শিল্পকার্য, চুলচেরা বিশ্লেষণের পরেও প্রশ্নগুলির সদুত্তর মেলে না।
মনোবিদ জয়িতা সাহা মনে করছেন, রাগ-ক্ষোভ উগরে দিতে নানা অনৈতিক পন্থা গ্রহণ করা হয় অনেক সময়। সে সব ক্ষেত্রে কারও ব্যক্তিগত বিষয় তুলে কথা বলতেও কোনও দ্বিধা থাকে না। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বললেন, ‘আমরা মনে করি, যাঁর উপর রাগ, তাঁর দুর্বলতার জায়গায় আঘাত করলেই সে কষ্ট পাবে। তাঁকে লজ্জায় ফেলতে পারলেই হয়তো রাগ কমে যাবে। তখনই সেই ব্যক্তি সম্পর্কে নিম্নরুচির কথাবার্তা বলা হয়। এ ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে।’
সব মিলিয়ে প্রত্যেকেরই মত, সেক্স টয় ব্যবহার করা বা না-করা ব্যক্তিগত অভিরুচি, পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভরশীল। সেটি নিয়ে আলোচনা করা বা সেটিকে মাধ্যম করে কাউকে হেনস্থা করা, আসলে এখনও কোথাও গিয়ে ভাবনার দৈন্যকেই প্রকট করে তোলে। শুধু নারী নন, যে কোনও লিঙ্গের মানুষের সম্পূর্ণ অধিকার আছে নিজের যৌনসুখ অনুভব করার। সেটি তাঁর সঙ্গী বা সঙ্গিনীর উপর নির্ভরশীল নয়। সেটি নিয়ে অহেতুক আলোচনা সেই মানুষটির ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে আর কিছু নয়।