বর্তমান বেহালা কলকাতার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত হলেও মনে করা হয় এটি দক্ষিণ কলকাতার একটি প্রাচীন জনপদ। পরাধীন ভারতবর্ষে যখন ইংরেজদের রাজত্ব চলছে, তখন বেহালা ছিল একটি শহরতলি ও পৌরসভার অংশ। স্বাধীনতার পরে এটি কলকাতার অঙ্গীভূত হয়। তবে এই বেহালার নামকরণ কীভাবে হল এই নিয়ে প্রচলিত আছে অজস্র মতভেদ।
মনে করা হয়, বেহালা জায়গাটির অস্তিত্ব কলকাতা শহরের অনেক আগে থেকেই রয়েছে। আজ থেকে প্রায় ৮০০ বছর আগের কথা। পরিবারের নিষেধ উপেক্ষা করে বেহুলা স্বামী লখিন্দরের প্রাণ উদ্ধারের জন্য শবদেহ নিয়ে ভেসে যাচ্ছিলেন গাঙুরের পথে। তখন নদীগুলির গতিপথ ছিল একেবারেই আলাদা। এখন আমরা যাকে হুগলি নদী বলে চিনি তা ছিল অনেক সংকীর্ণ। তখন গঙ্গা বলতে বোঝাত আদিগঙ্গাকেই। ভৌগলিক মানচিত্র অনুযায়ী তখন এই নদী চিতপুর থেকে বাঁক নিয়ে কালীঘাট, বারুইপুর হয়ে মিশত গঙ্গাসাগরে।
কথিত আছে, বেহুলা এই দীর্ঘ প্রতিকূল নদীপথে যাত্রাকালীন একবার কালীঘাটের দক্ষিণে একটি ঘাটে এসে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। পরে সেই ঘাটেরই নাম হয়ে যায় 'বেহুলার ঘাট'। এরপর লোকমুখে ছড়িয়ে ও পরিবর্তিত হতে হতে এই অঞ্চলের নাম হয় বেহালা।
এখন যে ঝাঁ চকচকে বেহালাকে আমরা দেখি, এমনটা কিন্তু পূর্বে ছিল না। তখন বেহালা ছিল ঘন জঙ্গলে ঘেরা এবং মৌমাছি প্রতিপালনকারী ও মৎস্যজীবীদের বাসভূমি।
অন্যদিকে এমন ধারণাও প্রচলিত আছে যে, বেহালার প্রথম শাসক ধনঞ্জয় মিত্র ছিলেন দেবী চন্ডীর ভক্ত। আর চণ্ডীর অপর নাম বহুলা। তাই অনেকে মনে করেন, চন্ডীর প্রতি অশেষ ভক্তি ও শ্রদ্ধার জায়গা থেকেই এই অঞ্চলের নামকরণ হয়েছিল বেহালা। কালীভক্তদের ভিড়ে সেই সময় শাক্তদের জাঁকজমকপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল এই ঘাট। ব্যবসার সুযোগ দেখে বণিকরাও এখানে বসতি গড়তে শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে বেহালা একটি সমৃদ্ধ জনপদে পরিণত হয়, এমনটাই শোনা যায়।
ঐতিহাসিক বিভিন্ন নথিপত্র বলছে, বেহালা চিরকালীনই একটি জনবহুল বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। কালীঘাট ও গঙ্গাসাগরের মধ্যমণি ও বিশিষ্ট তীর্থস্থান হিসেবে খ্যাত ছিল। সেই সময় এই অঞ্চলটি অসংখ্য গ্রামে পরিবেষ্টিত ছিল। প্রতিটি গ্রামের শেষে বেহালা যোগ করে এই অঞ্চলগুলির নামকরণ করা হয়েছিল। যেমন, বাজারবেহালা, বোঁড়শেবেহালা, সরশুনোবেহালা, নস্করপুরবেহালা ইত্যাদি। এই সরশুনোবেহালাতেই নাকি বাংলার বারো ভূঁইয়াদের একজন, বসন্ত রায় বাস করতেন।
পরে মুঘলদের রাজত্বে আকবরের উত্তরসূরী হিসেবে লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। বোঁড়শেবেহালা অর্থাৎ যাকে আমরা আজ বড়িশা বেহালা নামে চিনি, এটি তাঁর রাজধানীতে পরিণত হয়।
আবার অনেকে মনে করেন, বেহালা নামটি এসেছে ‘বিল’ ও ‘হাল’ শব্দের সংমিশ্রণ থেকে। একসময় এই অঞ্চলটি জলাভূমি দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। 'বিল' অর্থাৎ জলাভূমি এবং 'হাল' অর্থাৎ চাষের জমি—এই দুটি শব্দের মিলনে বেহালা নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
বেহালা নামকরণের উৎপত্তি নিয়ে একাধিক মতামত রয়েছে তাই নিশ্চিত করে বলা যায় না কোনটি সঠিক। তবে বেহালা এখনো কলকাতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, এ কথা অনস্বীকার্য।
আরও পড়ুন - Pearl History: কীভাবে গয়নার ‘মর্যাদা’পেল মুক্তো? ইতিহাসের এই কাহিনি হয়তো অনেকেরই অজানা