বর্তমান সমাজে মেয়েরা এখন অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন। তবে 'বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও' কোথাও মহিলাদের ইনসেন্টিভ বা সান্ত্বনা পুরস্কার হয়ে থেকে যাচ্ছে না তো? ২০১৯ এ করোনাকালীন ভয়াবহতার মধ্যে আশার আলো দেখিয়েছিলেন যিনি, এমআরএনে রিসার্চ দ্বারা সফল কোভিড ১৯ ভ্যাকসিন তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন যেই মহিলা গবেষক, তার নাম কি আমরা মনে রেখেছি?
মানুষের মননে তথা স্কুল কলেজের টেক্সটবুকে জায়গা করে নেওয়া অন্যতম বিখ্যাত দার্শনিক রেনে ডেকার্ত 'ইভিল ডিমন' এর থট এক্সপেরিমেন্টটি চুরি করেছিলেন যে মহিলার থেকে, তার নাম কি আমরা জানি?
ইতিহাসের পাতায় ভারতীয় সমাজসংস্কারক হিসাবে থেকে যাওয়া জ্যোতিরাও ফুলের নাম আমাদের কাছে অপরিচিত নয় কিন্তু তার স্ত্রী সাবিত্রী বাই ফুলে'-র কাহিনি অনেকেরই অজানা। প্রতিদিন দৃঢ়চেতা এক মনোভাব নিয়ে ছাত্রদের পড়াতে যেতেন সাবিত্রী বাই ফুলে। তৎকালীন সময়ে মহিলাদের পড়ানো তো দূর শিক্ষাগ্রহণের সুযোগই ছিল কম। পড়াতে যাওয়ার পথে তার গায়ে প্রতিদিন কাদা ছিটিয়ে দেওয়া হত এবং প্রতিদিন তিনি কাপড় বদলে ফের পড়াতে যেতেন।
ইতিহাস থেকে মুছে যাওয়া এমন অনেক নামই নারীদের এবং এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। নারীরা যে কেবল হারিয়ে যাচ্ছেন তাই নয়, তাদের অনুপস্থিত করা হয়েছে। যেমনটি ইতিহাসবিদ ডেভিড নোবেল 'আ ওয়ার্ল্ড উইথ আউট উইমেন' (১৯৯২) এ যুক্তি দিয়েছিলেন।
বিংশ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য নাম মেরি হেসেও মুছে গেছেন আমাদের সমষ্টিগত স্মৃতি থেকে। যুক্তিবাদের তত্ত্বে তাঁর প্রস্তাবিত ধারণাগুলি ছিল ক্ষেপনাস্ত্রের মত সাংঘাতিক।দর্শন অধ্যয়ন করার আগে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপিতে তিনি পিএইচডি সম্পন্ন করেন ১৯৬০ সালে।তিনি প্রথমে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নবপ্রতিষ্ঠিত ইতিহাস এবং বিজ্ঞানের দর্শন বিভাগে একজন প্রভাষক এবং পরে অধ্যাপক হন, যেখানে তিনি পরে অবসর গ্রহণ করেন এবং মারা যান।
হেসের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়টা ছিল কঠিন: 'মেরি একজন নারী হওয়ার কারণেই কলেজ জীবন থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন,' ইতিহাসবিদ স্যার রিচার্ড ইভান্স তার টাইমস শোকবার্তায় স্মরণ করেছেন। ১৯৫৭ সালে ব্রিস্টলে কলস্টন রিসার্চ সোসাইটির নবম সিম্পোজিয়ামে তোলা একটি ছবি আছে, যেখানে হেস ছাড়া ৪২ জন পদার্থবিদ এবং দার্শনিক ছিলেন, যারা সকলেই পুরুষ।
তার কর্মজীবনের শেষের দিকে, তিনি জনসমক্ষে প্রকাশ্য মঞ্চ থেকে উধাও হতে শুরু করেন। গুজব রয়েছে যে এই অবসরের সাথে অবসাদের একটি যোগ ছিল। যদিও বিদ্রোহী নারীদের কণ্ঠস্বর দমন করে দেওয়ার অস্ত্র হিসাবে তাদের 'পাগল' বা 'হিস্টেরিক' বলে দেগে দেওয়ার কৌশল ইতিহাসে নতুন নয়।
আরও পড়ুন - প্রকাশিত হল IBPS PO Mains স্কোরকার্ড ২০২৪, কীভাবে দেখবেন?
হেসের যে বইটি সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিল, সেটি আজ মুদ্রণেরও বাইরে। ইতিমধ্যে, থমাস কুনের জনপ্রিয় বই ‘The Structure of Scientific Revolutions’ (১৯৬২), যা তার ‘Models and Analogies’ বইটির মাত্র এক বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল , বারবার পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে এবং এই ক্ষেত্রে একটি ক্লাসিক হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে।
এটি কেবল রুচি বা ব্যক্তিগত পছন্দের বিবৃতি নয়। এটি ইতিহাসের একটি যুক্তি যার ভুলে যাওয়ার ও ভুলিয়ে দেওয়ার এই প্রবণতা রয়েছে।
আরও পড়ুন - 'আমার মা হিন্দু...', গো-মাংস ছোঁন না সলমন, হিন্দুধর্মের প্রতি রয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা
উনিশ শতকের নারীমুক্তি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ নাম হিসাবে বিদ্যাসাগর, রামমোহনের নাম আমরা মনে রাখলেও 'তারবাই শিন্ডে' এর নাম প্রায় উচ্চারিত হয় না। ১৮৮২ সালে মারাঠি ভাষায় তার প্রথম প্রকাশিত বই 'স্ত্রী-পুরুষ তুলনা', ভারতের প্রথম নারীবাদী গ্রন্থ।
অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরকার দ্বন্দ্ব থেকে লেখা উপন্যাস 'স্বরলিপি' এর লেখিকা সাবিত্রী রায়ও এই বিস্মৃতির ধারাবাহিকতার শিকার। ১৯৫২ সালে প্রকাশিতj হওয়া এই বইটি নিয়ে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। পরে নিষিদ্ধ করা হয় বইটি। এখন বইবাজারে এই বই উধাও হয়ে গেছে, এই উধাও হয়ে যাওয়া নারীদের অস্তিত্বের মতোই।