খুব নিরুপায় হয়ে চিঠিটা লিখতে বসেছি। সমস্যাটি এমন যার কোনও সমাধান আমার জানা নেই। কাউকে বললে, তারা বিশ্বাসও করতে চায় না। উলটে হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছি। এখন ভরসা আপনারাই। যদি কেউ কোনও পরামর্শ দিতে পারেন, তাহলে বড় উপকৃত হব।
আমার বিয়ে হয়েছে মোটামুটি বছর দেড়েক হল। আমরা এমনিতে ভালোই ছিলাম। শহরে একটি ফ্ল্যাটে আমরা দু’জনে থাকতাম। ফ্ল্যাটটি ছোট। শহরে আমার কোনও আত্মীয় নেই। সকলেই গ্রামে থাকেন। ফলে যত দিন একা ছিলাম, ওই ফ্ল্যাটেই দিব্যি চলে যেত। কিন্তু বিয়ের পরে জায়গা নিয়ে সমস্যা হতে থাকল। তাই আমরা উঠে এলাম একটু মফসসলের দিকে একটি ফ্ল্যাটে। এখানে ফ্ল্যাটটা সবে তৈরি হয়েছে। বেশি আবাসিক এখনও আসেননি। আমরা থাকি তিন তলায়। আমাদের নীচের ফ্ল্যাটগুলো এখনও খালি। চার তলায় আর পাঁচ তলায় একটি করে ফ্ল্যাটে লোকজন থাকেন। বাকি গোটা বাড়ি খালি।
এমনিতেই বাড়িটা একটু গা ছমছমে। তার মধ্যে আসার পর থেকেই এথ খালি বাড়ি দেখে কেমন যেন ভয় ভয় লাগত। কিন্তু এক দিন একটা ঘটনার পরে ভয় বেড়ে গেল।
সন্ধ্যার সময়ে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। বাইরের গেটের সামনে একজন সিকিওরিটি গার্ড থাকেন। তার পরে বেশ খানিকটা লম্বা উঠোনের মতো জায়গা। তার পরে এক তলা দিয়ে ঢোকার রাস্তা। তার পরেই বাঁ দিকে ঘুরে সিঁড়ি।
সিঁড়ির সামনে একটা আলো লাগানো থাকে। সেদিন দেখলাম, অন্ধকার। ভাবলাম, পরদিন সিকিওরিটির ভদ্রলোককে বলতে হবে। ভাবতে ভাবতেই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। হঠাৎ মনে হল, সিঁড়ির তলায় কেউ একটা রয়েছে। মোবাইলের আলো জ্বেলে সিঁড়ির নীচে ফেললাম। কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু স্পষ্ট মনে হল, কেউ একটা আছে।
যাই হোক, পর দিন আলোর ব্যবস্থা হল। সমস্যা আর দেখা দিল না। কিন্তু কয়েক দিন বাদের কথা। আবার একদিন অফিস থেকে ফেরার সময়ে দেখি, আলো নেই। এবার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে সিকিওরিটির ভদ্রলোককে বললাম। উনি বললেন, ইলেকট্রিক কানেকশনটায় সমস্যা আছে। তাই আলোটা বারবার কেটে যায়। পরের দিন ঠিক করে দেবেন বললেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাচ্ছি, আবার সেই আগের দিনের মতো। মনে হল, কেউ একটা আছে। মোবাইলের আলো জ্বাললাম। কেউ নেই।
দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলাম। মনে হল, পিছন পিছন কেউ একটা আসছে। ছুটে উঠে এলাম।
এই পর্যন্ত মারাত্মক ভয়েরই ছিল ঘটনাটা। কিন্তু এর ক’দিন পরেই সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে স্নানে গিয়েছে। ফিরে এসে দেখি, ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। আমার স্ত্রী বাইরে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বাইরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছে। বলল, মনে হল নীচে একটা কথা বলছে। আমি তাড়াতাড়ি ভিতরে আসতে বললাম।
ভয় পেয়েছি দেখে, আমার স্ত্রী হেসে বলল, ‘এত ভয় পাওয়ার কী আছে! বোধহয় বিড়াল!’
তা সে যাই হোক না কেন, আমি মোটেই বিশ্বাস করিনি, ওটা বিড়াল। এর পরেও গত কয়েক মাসের মধ্যে ঘটনাটি বেশ কয়েক বার ঘটেছে। দেখেছি, ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। বাইরে গিয়ে দেখেছিস সিঁড়ির মুখে আমার স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। কখনও কখনও কথাও বলতে শুনেছি ওকে। জিজ্ঞাসা করলে বলেছে, ফ্ল্যাটের ভিতরে ফোনের নেটওয়ার্কের সমস্যা হয়। ওই দিকটায় নেটওয়ার্ক ভালো থাকে। তাই ফোন এলে ওখানে যায়।
কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ফ্ল্যাটের সিঁড়ির নীচে কেউ একটা থাকে। আমার বউ তার সঙ্গে কথা বলে। এ সব ভেবে রাতে আমার ঘুম হয় না। ভয় করে প্রচণ্ড ভয়। আমি কী করব?
বিশেষজ্ঞের জবাব:
সম্পর্কবিদ মৌমিতা গুপ্ত এই বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য:
প্রথমেই আপনাকে বলে রাখা দরকার, আপনি যাঁর কাছে চিঠি লিখেছেন, তিনি সম্পর্ক সম্পর্কে পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু তিনি মনোবিদ নন। তাই এ সম্পর্কে মতামত দেওয়া একটু কঠিন।
তবে একটি কথা আপনাকে না বললেই নয়। আপনি যে বিষয়টি নিয়ে ভয় পাচ্ছেন, সেটি আসলে কোনও মানুষ বা প্রাণী নয়। খুব সম্ভবত সেটি অন্ধকার। ইংরেজিতে একে বলে ‘নিক্টোফোবিয়া’। হতে পারে, আপনি এমনই কোনও সমস্যায় রয়েছেন।
এর পিছনে নানা কারণ থাকতে পারে। থাকতে পারে ছোটবেলার কোনও ঘটনা এবং তা থেকে সৃষ্টি হওয়া ভয়ও। সে সম্পর্কে আপনার চিঠিতে যেহেতু কিছু বলা নেই, তা এ নিয়ে মন্তব্য করা উচিত হবে না।
শুধু একটি বিষয়ে বলা দরকার। এক্ষেত্রে আপনার স্ত্রীর উপর সন্দেহ রেখে কোনও লাভ নেই। হতে পারে আপনাদের ফ্ল্যাটে ফোনের নেটওয়ার্কের সত্যিই সমস্যা হয়। আর তাই তিনি অন্য দিকে কথা বলতে যান। সে কথা আপনিই ভালো জানবেন। এমনটাও হতে পারে, উনি পরিবারের কারও সঙ্গে একটু আলাদা করে কথা বলতে চান। হয়তো চান না, সে কথা আপনার সামনে বলতে।
অনেক মানুষেরই এই ব্যক্তিগত পরিসরটুকু দরকার হতে পারে। এমন কোনও বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতেও উনি সিঁড়ির দিকে যেতে পারেন, যে কথা একান্ত ব্যক্তিগতভাবে বলতে চান। ফলে এই বিষয়টি নিয়ে বেশি চিন্তা না করাই ভালো।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, যে সব পরিচিতরা আপনার এই সমস্যাটি নিয়ে হাসাহাসি করছেন, তাঁদের এড়িয়ে চলুন। বরং আপনার এই সমস্যা এবং যাবতীয় সন্দেহ নিয়ে দ্রুতই কোনও মনোবিদের পরামর্শ নিন। উনি হয়তো আপনার সিঁড়ির নীচের অন্ধকার-সহ আপনার মনের অনেকটা অন্ধকারও দূর করতে পারবেন।