আজ অন্নপূর্ণা পুজো। কথিত আছে, দেবী পার্বতীরই আর এক রূপ হলেন অন্নপূর্ণা আর তাঁর পুজো করলে বাড়িতে কোনও অন্নাভব থাকে না। সব অভাব, অভিমান ঘুচে সংসার শান্তি ও সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে বাঙালির কাছে দেবী অন্নপূর্ণা যেমন খুবই কাছের, ঠিক সে রকমই সুরালকের এক অনন্য উজ্জ্বল হীরে হলেন সেতার সম্রাজ্ঞী অন্নপূর্ণা দেবী।
ইতিহাস তাঁর পরিচয় দিয়েছে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের কনিষ্ঠ কন্যা হিসেবে, বাঙালির কাছে তিনি পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রথমা স্ত্রী আর অনেকের কাছে আবার ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের বোন। তবে সুর হোক বা তাল, সেতারের মূর্চ্ছনায় সর্বশক্তিমানের আশীর্বাদ পাওয়া অন্নপূর্ণা দেবী ছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি। বহির্বিশ্ব তাঁকে জেনেছে কম বা উনি হয়তো জানার সুযোগও দেননি সে রকম। তাই বলে ওঁর কৃতিত্ব এতটুকু কমে যায় না!
রোশনারা আলি আর অন্নপূর্ণা দেবী, একই মানুষ। মহারাজা ব্রিজনাথ সিংহ তার নাম রাখেন অন্নপূর্ণা।
বড় বোনকে তালিম দিলেও, ছোট মেয়ের ক্ষেত্রে অন্যথা করেছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব। কিন্তু যাঁর মধ্যে এত শেখার ইচ্ছা, এত প্রত্যয়, তাঁকে কি বঞ্চিত করা যায়? প্রথমে ধ্রুপদী কণ্ঠ সঙ্গীত আর তার পরে সেতার— নিজের কিংবদন্তি বাবা যখন গুরু, তখন সেরা হয়ে ওঠাটা বোধহয় স্বাভাবিক হয়।
মাইহারে তখন উপস্থিত পণ্ডিত রবিশঙ্করও, গুরুজির কাছে তালিম নিতে। ১৩ বছরের অন্নপূর্ণার সঙ্গে ১৯ বছরের রবির কোনও প্রেম ছিল না। সম্পূর্ণ একটি পারিবারিক বিয়ে হল। কিন্তু সেই বিয়ে সুখের হল না। একমাত্র ছেলে শুভশঙ্করের জীবনে অনেক উত্থান পতন ছিল, মাত্র পঞ্চাশেই পরলোকগমন করেন তিনি। তবে এই লেখা কিন্তু রবিশঙ্কর ও অন্নপূর্ণা দেবীর সম্পর্ক নিয়ে নয়। দু’জনেই কখনও কাদা ছোড়াছুড়ি করেননি জীবদ্দশায় আর সব সুখ হয়তো সকলের জন্য হয় না।
সেতারবাদক হিসেবে কেমন ছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী?
ভারতের ইতিহাসে মহিলা কণ্ঠশিল্পীর অনেক উদাহরণ থাকলেও, ভীষণ জনপ্রিয় মহিলা ধ্রুপদী সেতারবাদক তেমনভাবে নেই বললেই চলে। ঐতিহাসিক ভাবে ভারতীয় সংস্কৃতিতে বাড়ির মেয়েদের গান বা নাচের তালিম দেওয়ার চর্চা রয়েছে। সেখানে অন্নপূর্ণা দেবী ছিলেন অনন্যা।
স্বয়ং উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব নিজের মেয়েকে তালিম দেওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘তোমাকে গুরুর মতো শেখাতে চাই। কারণ তোমার মধ্যে কোনও লোভ নেই।’ খাস উস্তাদজির কাছে সুরবাহানের প্রশিক্ষণ হয়েছিল তাঁর।
পরবর্তীকালে তিনি পারফর্ম করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন বটে কিন্তু সুরসাধনা থেমে যায়নি। একজন প্রকৃত সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে তালিম দিয়েছেন শিষ্যদের। যদি ওঁর শিষ্যদের কথা বলা হয়, সেখানে রয়েছে একের পর এক মহীরুহের নাম— হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ বাহাদুর খান, পণ্ডিত নিত্যানন্দ হলদিপুর, ওস্তাদ আশিস খান, অমিত ভট্টাচার্য, প্রদীপ বারট-সহ অনেক অনেক দিকপালেরা।
সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ওঁর একটি বিশেষ ফারাক রয়েছে। সমাজ ও কাজ থেকে মহানায়িকার স্বেচ্ছাবসরের জন্য অনেক কারণ ছিল, গুণগত মান নিয়ে প্রশ্নও ছিল। কিন্তু অন্নপূর্ণা দেবী যত দিন বেঁচে ছিলেন, নিভৃতে সঙ্গীতের দীক্ষা দিয়ে গিয়েছেন অগণিত শিষ্য তথা গুণমুগ্ধকে।
তাই আজ অন্নপূর্ণা পুজোর দিনে নামের সাযুজ্যের কারণেই মনে পড়তে বাধ্য এই সুরের দেবীর কথাও। রোজকার মতোই আরও একবার শ্রদ্ধা জানাতে হবে অন্নপূর্ণা দেবীকে।