রণবীর ভট্টাচার্য
চুনি গোস্বামী থেকে ভাইচুং হয়ে রয় কৃষ্ণা, সেরার সেরা গোল স্কোরার দেখেছে ভারত। মিডফিল্ডার থেকে ডিফেন্স, প্রতিটা দশকেই এসেছে তারকা ফুটবলার, কখনও দেশের, কখনও বিদেশের। কিন্তু কোচ? প্রাক্তন ফুটবলাররা কোচ হয়েছেন কিংবা মধ্যমানের বিদেশি লোকের ভিড়— কিন্তু ভালো কোচ এসেছেন কি? আইএসএল এর দৌলতে ভারত দেখেছে জিকোকেও। একজন অমল দত্ত আর আসেননি ভারতীয় ফুটবলেও। আজ ওঁর জন্মদিনে ফিরে দেখা সেই দিনগুলো। ময়দানে আজ পিকে মানে প্রশান্ত কিশোর, অমল দত্তর মতো বাঙালি কোচ নেই, আর ডায়মন্ড স্রেফ হাওড়া-ধানবাদের ট্রেনের নাম রয়ে গিয়েছে।
খেলোয়াড় অমল দত্ত অবশ্যই অসাধারণ ছিলেন না, সেই নিয়ে জীবদ্দশায় কোনও দাবিও ছিল না তাঁর। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলেছেন, দেশের হয়ে একটি মাত্র ম্যাচ খেলেছেন, যেটি আবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। খেলোয়াড় জীবন ইতি হওয়ার পরে ইংল্যান্ডে গিয়ে নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে এক বছরের এফ এ কোচিং কোর্স করে ফেরেন ময়দানের পুরনো ঘাসে। যাত্রা শুরু হাওড়ার বালির কোচিং ক্যাম্পে। তার পরে সন্তোষ ট্রফিতে রেলওয়েজকে কোচিং দিয়ে শুরু। ১৯৬৩ তে ইস্টবেঙ্গলের কোচ হয়ে বড় দলের গোলার্ধে ঢুকে পড়া।
জানেন, অমল দত্ত ভারতের প্রথম প্রফেশনাল ফুটবল কোচ? ১৯৬৪ সালে নিজের রেলের চাকরি ছেড়ে ঠিক করেন স্রেফ ফুটবল নিজের ধ্যানজ্ঞান হবে, তাও আবার ভারতে।
নিজের দীর্ঘ কোচিং জীবনে অমল দত্ত কয়েক দফায় তিন বড় দলকেই কোচিং করিয়েছেন, ভারতীয় দলের কোচ হয়েছেন। কোচিং জীবনের শেষ দিকে টালিগঞ্জ অগ্রগামীর মতো দলের তরুণ ফুটবলারদের হাতে ধরে ফুটবলের অ-আ-ক-খ শিখিয়েছেন। আর ট্রফি ওঁকে চিনে এসেছে। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে জিতেছেন লিগ (২ বার), শিল্ড (২ বার), রোভার্স কাপ, ডুরান্ড কাপ, দার্জিলিং গোল্ড কাপ, বরদুলুই ট্রফি, এয়ারলাইন্স গোল্ড কাপ, সঞ্জয় গান্ধী গোল্ড কাপ এবং এটিপি শিল্ড; মোহনবাগানের হয়ে জিতেছেন লিগ (৪ বার), শিল্ড (৪ বার), ফেডারেশন কাপ (৩ বার), ডুরান্ড কাপ (২ বার), ডিসিএম ট্রফি, এয়ারলাইন্স গোল্ড কাপ, সিকিম গভর্নরস গোল্ড কাপ এবং নেহরু ট্রফি। মহামেডানের হয়ে ১৯৮০ সালে অমল দত্ত জিতেছিলেন রোভার্স, ডি সিএম, সিকিম গভর্নরস গোল্ড কাপ।
তবে কোচ হিসেবে কেন স্পেশ্যাল ছিলেন অমল দত্ত? এর উত্তর কিন্তু লুকিয়ে আছে ফুটবল ফর্ম্যাসনে। পিকে বা সমসাময়িক কোচেরা যখন জোর দিয়েছেন ভালো-দামি খেলোয়াড়ে কিংবা ম্যান ম্যানেজমেন্টে, সেখানে অমল দত্ত চোখ রেখেছেন ইউরোপিয়ান তথা বিশ্ব ফুটবলে। সেখান থেকেই চেষ্টা করেছেন ময়দানে ফুল ফোটানোর। গাছের পাতা, ইঁট, পাথর জোগাড় করে যখন অমল দত্ত পইপই করে মোহনবাগানের ফুটবলারদের বুঝিয়েছিলেন ৩-২-৩ -২ ছক, তখন ময়দানের ডায়মন্ড প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। ইউরোপের ফুটবলে যখন ঝড় তুলেছে এসি মিলান তাদের তারকাখচিত টিম নিয়ে, যায় স্তম্ভ ছিলেন আন্দ্রে পিরলো, আর সেখানে ১৯৯৭-এর অমল দত্তর মোহনবাগান টিম? এখন বাঙালি ফুটবলার বলতে টিম টিম করে জ্বলছে সেই প্রীতম কোটাল, দেবজিৎ মজুমদার, প্রবীর দাস, প্রণয় হালদাররা। কে জানে, এঁরা যদি অমল দত্তর কোচিং পেতেন, তাহলে হয়তো আবার ময়দানি ম্যাজিক দেখা যেতে পারত...
সেই ক্ষ্যাপাটে, তথাকথিত ফুটবল পাগল কোচকে ভীষণ দরকার ভারতীয় ফুটবলের।
অনেক শ্রদ্ধা রইল আপনার জন্য, অমল দত্ত।