রণবীর ভট্টাচার্য
১০ মে। ১৮৫৭ সালে এই দিনেই অবিভক্ত ভারতে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। ইতিহাসবিদদের মতে, এই সিপাহি বিদ্রোহকে স্বাধীনতার জন্য প্রথম যুদ্ধ বলা যায়। মীরাটে শুরু হয়ে আগ্রা, দিল্লি, কানপুর, লখনৌ জুড়ে এই বিদ্রোহ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি টের পেয়েছিল যে বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে রূপান্তরিত হলেও তাদের আসন টলমল এই দেশে। বলতে দ্বিধা নেই যে সিপাহি বিদ্রোহ স্বাধীন ভারতের স্বপ্নকে দিশা দেখিয়েছিল।
সিপাহি বিদ্রোহের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক ভোলার নয়। সিপাই মঙ্গল পাণ্ডের নাম ভারতের প্রতিটি শিশু জানে আজ। ১৮৫৭ সালের ২৯শে মার্চ ব্যারাকপুরে ৩৪ নাম্বার বাংলা ইনফ্যান্ট্রির সিপাই মঙ্গল পান্ডে অফিসারদের আক্রমণ করেন। যখন ওনার ইনফ্যান্ট্রির বাকি সিপাইদের মঙ্গল পান্ডেকে আটকানোর জন্য, কেউ এগিয়ে আসেনি। তবে তারা সরাসরি বিদ্রোহে যোগ দেয়নি। তবে ১০ই মে মীরাটে তিন নাম্বার বাংলা লাইট ক্যাভালরির ৮৫ জন সদস্য যারা নতুন কার্টিজ ব্যবহার না করার জন্য জেলে ছিলেন, তাদের সহকর্মীরা জেল ভেঙে মুক্ত করেন। এরপর তারা কাছের মিলিটারি স্টেশন আক্রমণ করেন এবং আক্রমন করতে আসা ইউরোপিয়ানদের হত্যা করেন। এরপরের দিন বিদ্রোহীরা দিল্লির দখল নেয় এবং অন্যত্র এই বিদ্রোহের খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই অবস্থায় সিপাইদের বেশ কিছু ইউনিটকে ভেঙে দেওয়া হয়। কিছু ইউনিটের সিপাই বিদ্রোহে যোগ দেয়নি বটে তবে তারা কোন পক্ষেই যোগ দেয়নি, বাড়ি ফিরে যায়।
সেই সময় ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে ৩৫,০০০ ব্রিটিশ সৈন্য ছিল। বাইরের থেকে তাদের সাহায্য আসতে সময় লেগেছিল। ব্রিটিশদের সৌভাগ্য যে এই বিদ্রোহ অনেকটাই বাংলার সিপাইদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তৎকালীন বোম্বাই, মাদ্রাজের সৈন্যদের মধ্যে সেরকম প্রভাব পড়েনি। অনেকের মতে ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে শিখ, পাঞ্জাবি মুসলমান এবং গোর্খাদের মধ্যে এর প্রভাব পড়েনি কারণ তাদের ভয় ছিল যদি না আবার মুঘল আমল ফিরে আসে। অনেকে আবার বাংলার উচ্চবর্ণের সিপাইদের এই লড়াইয়ের সাথে একমত হতে পারেননি।
সিপাহি বিদ্রোহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেশছাড়া করতে পারেনি বটে, কিন্তু দেশের মধ্যে ভারতীয় সত্বা প্রথমবার বোঝাতে পেরেছিল। সৈন্যবাহিনী ছাড়াও অনেকেই এই সিপাহি বিদ্রোহে যোগদান করেছিলেন - কারোর ছিল ধর্মীয় উপলব্ধি কারোর ছিল সামাজিক কারণ। সিপাহি বিদ্রোহ সমাজের অনেক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। এটাই ছিল সিপাহি বিদ্রোহের সাফল্য। এছাড়া পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য পটভূমি প্রস্তুত করেছিল। আর নিসন্দেহে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ে বাংলা প্রস্তুত হয়েছিল যার ফলস্বরূপ বাংলার বিপ্লবীরা আগুয়ান হয়েছিলেন। বলতে বাধা নেই, সিপাহি বিদ্রোহ সশস্ত্র সংগ্রামের কার্যকারিতা নিয়ে প্রথমবার দিশা দেখিয়েছিল পরাধীন ভারতবর্ষে। তাই ভারতের ইতিহাসে সিপাহি বিদ্রোহের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।