রণবীর ভট্টাচার্য
রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের স্নাতকোত্তরের ক্লাসে রাষ্ট্র নিয়ে বিশদে আলোচনা হয়ে থাকে। কিন্তু আমজনতার কাছে সেই সুযোগ আর হয়ে ওঠে কই! তবে দেশ জুড়ে এখন আলোচনা রাষ্ট্রদ্রোহ আইন নিয়ে, যেই আইন প্রণয়ন হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের আমলে। আইনত, এক সময়ে যা পরাধীন ভারতীয়দের জন্য বলবৎ ছিল, তা হালফিলহাল স্বাধীন ভারতীয়দের উপরও দায়ের করে যেত বা হয়েছেও স্বাধীনতা পরবর্তী ৭৫ বছরে। সুপ্রিম কোর্টের আদেশানুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহ আইন স্থগিত হয়েছে। আপাতত রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। এই আইন সম্পর্কিত সমস্ত মামলা আপাতত স্থগিত থাকবে। বর্তমানে এই আইনে জেলে থাকা বন্দিদের জামিনের আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শীর্ষ আদালতের এই বক্তব্য ভারতীয় সংবিধানের নিরিখে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ।
রাষ্ট্রদ্রোহ কী?
রাষ্ট্রদ্রোহ আইন জানার আগে বোঝা দরকার রাষ্ট্রদ্রোহ বলতে কী বোঝানো হয়ে থাকে। এটি বলতে এমন এক ধরনের অপরাধকে বোঝানো হয় যেখানে অপরাধীর দ্বারা প্রত্যক্ষ ভাবে অবৈধ বা অসাংবিধানিক উপায়ে নিজের রাষ্ট্রের পতন কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানের দৈহিক ক্ষতিসাধন বা তার প্রয়াস অথবা নিজের দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করা অন্য দেশকে। এই সমস্ত কার্যকলাপকে রাষ্ট্রদ্রোহের অন্তর্ভুক্ত বলা যেতে পারে। বর্তমান সময়ের নিরিখে বলা যেতে পারে, দেশের সরকারের কোওন সংবেদনশীল তথ্য ফাঁস করে অন্য রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিলে (যার ফলে দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে) বা গুপ্তচরবৃত্তির মতো অপরাধকেও রাষ্ট্রদ্রোহ বলা চলে।
রাষ্ট্রদ্রোহে যেই ব্যক্তি দোষী, তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী বা দেশদ্রোহী বলা হয়ে থাকে। অনেক দেশেই রাষ্ট্রদ্রোহের শাস্তি হিসেবে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তির নিদান দেওয়া রয়েছে। এমনকী অনেক দেশে রাষ্ট্রদ্রোহীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার চল রয়েছে।
ভারতীয় রাষ্ট্রদ্রোহ আইন
ইন্ডিয়ান পিনাল কোড তথা ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ রাষ্ট্রদ্রোহ আইন অনুসারে যদি কোন ওব্যক্তি শব্দ দ্বারা, কথ্য বা লিখিত, বা লক্ষণ অথবা চিহ্ন দ্বারা, বা দৃশ্যমান অথবা ছবির উপস্থাপনার সাহায্যে দেশের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা অবমাননা ছড়ানোর চেষ্টা করেন বা জনতাকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেন, তাহলে সেই ব্যক্তি বা সংগঠন রাষ্ট্রদ্রোহ আইন (১২৪এ) অনুসারে দণ্ডিত হবেন, যা তিন বছর পর্যন্ত হতে পারে। প্রয়োজনে এর সঙ্গে জরিমানা যোগ করা যেতে পারে।
রাষ্ট্রদ্রোহ আইন ও বাংলা
১৮৯১ সালে বাংলা ম্যাগাজিনের এডিটর যোগেন্দ্রচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে এই আইনে অভিযোগ এনে বলা হয় যে, তাঁরা ব্রিটিশ সরকার বিরোধী কাজ করেছেন বা সমালোচনা করেছেন। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে এটি প্রথম অভিযোগ ছিল পরাধীন ভারতে। এরপর বাল গঙ্গাধর তিলক থেকে মহাত্মা গান্ধী, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের গতিরুদ্ধ করতে অনেকবারই এই আইন কার্যকর করেছে ব্রিটিশ সরকার।
স্বাধীন ভারতে ১৯৫১ সালে তারা সিং গোপী চাঁদের বিরুদ্ধে এই আইনে অভিযোগ করা হয়। এরপর ১৯৫১ সালে ভারতীয় সংবিধানের প্রথম সংশোধনী আনা হয়। যেখানে বাক স্বাধীনতার মতো গুরত্বপূর্ণ দিকগুলির কথা মাথায় রাখা হয়। রাষ্ট্রদ্রোহের পরিধি একটু বাড়ে যেখানে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দিকটির উপর জোর দেওয়া হয়। এরপর আদিবাসী নেতা দেবী সরেন (১৯৫৪) কিংবা কেদার নাথ সিংয়ের কেসেও উঠে আসে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের বেশ কিছু দিক।
বিনায়ক সেন, প্রবীণ তোগাদিয়া, আকবরউদ্দিন ওয়াইসি, অসীম ত্রিবেদী, অরুন্ধতী রায়, হার্দিক প্যাটেল, দিশা রবি, কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদ, সাংবাদিক বিনোদ দুয়া, সিদ্দিকী কাপ্পান-সহ অনেকের বিরুদ্ধেই এই রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে, যার মধ্যে অনেক মামলার শুনানি চলছে আদালতে।
এই আইন কি ঔপনিবেশিক? রাষ্ট্রদ্রোহ আইন কি বাক স্বাধীনতা বিরোধী? এই আইন কি গঠনমূলক সমালোচনার বিরোধিতা করে? গণতন্ত্রের ভাবাবেগকে কি ক্ষুণ্ণ করে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন? স্বাধীন ভারতে কি আইনের আদৌ কোনও যৌক্তিকতা রয়েছে? সরকার পক্ষ কি আইন যেনতেন প্রকারে রাজনৈতিক বিরোধিতার দিক থেকে এই আইনের অপব্যবহার করে? যদি এই আইন রাখতেই হয়, তাহলে কী কী পরিমার্জন দরকার?
সামনের দিনে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে এই বিষয়গুলো উঠে আসবে। এর সঙ্গে চলতে থাকা মামলাগুলির ভবিষৎ নিয়েও থাকবে অনেক প্রশ্ন।