‘চড়ুই চড়ুই চড়ুইটি/ ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ওড়ে...’
চড়ুই বা চড়াই, যেই নামেই ডাকা হোক না কেন, বাঙালি জীবনে বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে চড়ুই। স্কুল জীবনে কবিতা মুখস্থ হোক কিংবা রান্নাঘরের জানলায় একটি ছোট পাত্রে কোনও এক নাম-না-জানা চড়ুইয়ের জন্য জল রেখে যাওয়া হোক— বাঙালিয়ানায় জড়িয়ে আছে চড়ুই। তবে আজকে তারা খুব বিপন্ন। পাড়ায় পাড়ায় রোলের দোকান দেখা যায়, মিষ্টিপ্রেমী বাঙালিকে রোববারের সকালে জিলিপি কিনতে দেখা যায়, কিন্তু চড়ুই স্রেফ ভ্যানিশ হয়ে গেল। কিন্তু কেন? রবিবার বিশ্ব চড়ুই দিবস। আজ এই নিয়ে অবশ্যই একটু ভাবার দিন।
রিফিউজি বাঙালি পরিবারে এখনও বাড়িকে বাসা বলার অভ্যাস রয়ে গিয়েছে। আজকের কলকাতায় অনেক কলোনি আর কলোনি নেই, অট্টালিকায় ভরে গিয়েছে। কিন্তু চড়ুইয়ের বাসা করার আর জায়গা নেই। বাড়িতে এসির বাড়বাড়ন্ত, তাই জানলা বন্ধ। ফ্ল্যাটবাড়িতে ঘুলঘুলি নেই। আর জানলার কার্নিশে জায়গা দখল করে বসে আছে এসির মেশিন। শহুরে মানুষের ভাবার সময় নেই, তাই একটু জল পাবে, সেই আশাও নেই। আর মোবাইল টাওয়ারের দিক থেকে, শহরের সঙ্গে দিব্যি পাল্লা দিয়ে যাচ্ছে গ্রাম। তার নিট ফল হল প্রাকৃতিক ভারসাম্যের দফারফা। এখন সাধের চড়ুইকে লড়াই করতে হচ্ছে কাক, পায়রাদের মতো বড় বড় পাখির সঙ্গে। শহরের আনাচে কানাচে এত তার। আগে ছিল বিদ্যুতের আর টেলিফোনের তার, আর এখন দোসর হয়েছে ইন্টারনেটের তার। অতিরিক্ত ফলনের জন্য ক্ষতিকারক কীটনাশকের ব্যবহার পরিস্থিতি করে তুলেছে গুরুতর। সব মিলিয়ে চড়ুইয়ের বেঁচে থাকার জন্য যা যা দরকার, তার উল্টো দিকেই হাঁটছে মানুষ।
বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে বলতেই হবে বাঘ, সিংহ বা অন্য প্রাণীর মতো সেই ভাবে চড়ুইয়ের সংখ্যা মাপার চেষ্টা হয়নি কখনও বা কোনও প্রচলিত প্রথাও নেই। চড়ুইকে নিয়ে সংরক্ষণ সম্পর্কিত কিছু ভাবাও হয়নি। এর ফলে কিছুটা অবহেলিত থেকে গিয়েছে চড়ুই পাখিরা। মানুষকে সচেতন করার সত্যি কোন বিকল্প নেই। তবে কিছু অভিনব উপায়ের কথা নিশ্চয়ই ভাবা যেতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম হল কৃত্রিম বাসা তৈরি করার কথা। দিল্লি-নয়ডায় এই নিয়ে ইতিবাচক ফল পাওয়া গিয়েছে ইতিমধ্যেই। এছাড়া উষ্ণায়নের কথা মাথায় রেখে যদি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত জীবনের বাইরে ভাবা যেতে পারে, তাহলে অবশ্যই তা চড়ুই বান্ধব হবে।
আপাত দৃষ্টিতে অনেকেই হয়তো বিচলিত হচ্ছেন না চড়ুইয়ের সংখ্যা উল্লেখজনকভাবে হ্রাস পাওয়া নিয়ে। কিন্তু সেদিনের সেই দিন কিন্তু খুব সুখের হবে না, যেদিন পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এই ছোট্ট পাখিরা। তাই দেরি না করে চড়ুইদের প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক পুনর্বাসন নিয়ে ভাবতে হবে বিলম্ব না করে।
নইলে, পরের প্রজন্ম হয়তো চড়ুই চেনার ক্ষেত্রে স্রেফ ইন্টারনেটের উপরই ভরসা করতে বাধ্য হবে!