গণমাধ্যমের সংজ্ঞা অনেকটাই বদলেছে এই শতাব্দীতে। মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য একটা ফোনই অনেক সময় যথেষ্ট। তবুও মানুষ আরেকজনের কাছে বা অনেকের কাছে পৌঁছেও যেন পৌঁছতে পারছে না। ঠিক সেখানেই বোধহয় নাটকের ব্যাপ্তি। বর্তমান সময়ে নাটকের মধ্যে সবচেয়ে কম নাটকীয়তা থাকে। নাটক বলুন কিংবা থিয়েটার, এই মাধ্যমের বিষয়বস্তু সব সময়েই যেন প্রাসঙ্গিক থাকে। আজ বিশ্ব থিয়েটার দিবস খুব গুরত্বপূর্ণ একটি সময়ে পালিত হচ্ছে। একদিকে চলছে শেষ হতে না চাওয়া রাশিয়া - ইউক্রেন যুদ্ধ আর আরেকটিকে হানাদার করোনা ভাইরাসের ভ্রুকুটি— সব মিলিয়ে প্রেক্ষাপট জটিল। প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ, যে যতই ভেবে থাকুন না কেন, প্রযুক্তির এত উন্নতি বা উদ্ভাবনের পরেও কিন্তু থিয়েটার এখনও কমবয়সীদের আকৃষ্ট করে, গর্জাতে শেখায় আবার সংঘবদ্ধ হওয়ার পাঠও দেয়!
থিয়েটার বা নাটক এমন একটি মাধ্যম, যেখানে মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা সবচেয়ে বেশি কিন্তু ব্যক্তিগত অবদান সবচেয়ে কম। সিনেমা বা সিরিয়াল দেখার প্রসার হয়েছে অনেকে কিন্তু নাটক রয়ে গিয়েছে অনেকটাই তাই পুরনো ফরম্যাটে। এটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় fallacy! খাস বাংলার কথাই যদি দেখা যায়, কমবয়সী ছেলেমেয়েরা অনেকেই হইহই করে নাটকের ক্লাস করে, স্টেজে নিজের ছাপ রেখে যায়, কিন্তু কতজন শেষ পর্যন্ত নাটকেই থেকে যায়? আজকের জমানায় অনেকেই নাটককে অভিনয়ের শিক্ষা হিসেবে দেখে। অনেক নামজাদা চিত্রপরিচালক তাই সোজাসাপটা জিজ্ঞেস করেই নেন যে পূর্ববতী নাটকের অভিজ্ঞতা রয়েছে কি না!
সামাজিক বা বৌদ্ধিক স্তরে নাটক নিয়ে কম আলোচনা হয়নি। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নাটকের গুরুত্ব অপরিসীম। গিরিশ ঘোষ থেকে আজকের হাটথ্রব অনির্বাণ ভট্টাচার্য— নাটকের মোহময়তা অবাক করে দেওয়ার মত। সিরিয়াল বা যৌনতাপূর্ণ একপেশে ওয়েব সিরিজের থেকে যে গড়পড়তা নাটকের গুণগত মান যে অনেক ভালো, তা বলতে সত্যি দ্বিধা নেই। তবে নাটক কিন্তু যাত্রার মতো হারিয়ে যায়নি। এটাও মনে রাখা দরকার সামাজিক ও অর্থনীতিক আঙ্গিকে।
তবে বুদ্ধিজীবী প্রবণ বাঙালির নাটকের ‘অতি নাটকীয় চরিত্র’দের বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ একান্ত প্রয়োজন। ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে যেখানে নাটকের কুশীলবরা তাবেদারী করছেন, নিজেদের বিবেক ও চেতনাকে বন্ধক রেখেছেন। দুঃখের যে সেই মানুষগুলো নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে নাটকের অবমাননা করে ফেলেন প্রায়ই। এই বুদ্ধিজীবীদের চিনে নেওয়া খুবই দরকার। নইলে তারা নিজেদের চেতনার কথা বলতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত বা দিকভ্রষ্ট করে ফেলেন।
নাটকের অর্থ দরকার। নইলে নাটক চিঠি-লেখার-অভ্যাসের মত আস্তাকুঁড়ে ঢুকে পড়বে। তাতে বড় নাটকের দলগুলো কর্পোরেট বা রাজনৈতিক আশীর্বাদে বেঁচে গেলেও ছোট ছোট দলগুলো হারিয়ে যাবে সামাজিক গোলকধাঁধায়।
তবে তারও আগে এই মাধ্যমের সবাইকে সৎ থাকতে হবে। বুদ্ধিজীবী হওয়া নয়, নাটক বা বাঙালির সাধের থিয়েটারকে চেতনার শুদ্ধস্বর হতে হবে।