ভারতের প্রধান বিচারপতির পদে দুই বছরের কাজের মেয়াদ শুক্রবারই সম্পূর্ণ করলেন বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। এরপর সেই দায়িত্ব পালন করবেন তাঁর উত্তরসূরি বিচারপতি সঞ্জীব খান্না।
প্রধান বিচারপতির আসনে থাকাকালীন, শেষ দিনটিতেও অসামান্য একটি ঘোষণা করেছেন তিনি। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু তকমা খারিজ করে ১৯৬৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের নিরিখে সেই রায় শুক্রবার খারিজ করেছে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চ।
এছাড়াও প্রধান বিচারপতি হিসাবে আর কী কী গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়? আসুন, দেখে নেওয়া যাক:
ইলেকট্রোরাল বন্ড মামলা:
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে এই মামলায় রায় দান করা হয়। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, ইলেকট্রোরাল বন্ডের মাধ্যমে যেভাবে অনুদানকারীর পরিচয় গোপন রেখে তাঁর থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ চাঁদা হিসাবে আদায় করে রাজনৈতিক দলগুলি, তা বেআইনি ও অসাংবিধানিক।
আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, এই ধরনের আর্থিক লেনদেনের ফলে পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট অনুদানকারীদের বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অবকাশ থাকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলির কাছে।
ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পত্তি মামলা:
চলতি মাসেই এই রায় ঘোষণা করে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন নয় সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ।
সংশ্লিষ্ট মামলার প্রেক্ষিতে আদালত স্পষ্ট করে, সমস্ত ধরনের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পত্তিকেই গোষ্ঠীর সম্পদ হিসাবে গণ্য করা যায় না। এবং রাষ্ট্র চাইলেই বৃহত্তর স্বার্থের নাম করে সেই সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে পারে না।
অনুচ্ছেদ ৩৭০:
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারা বিলোপের সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেয়। উল্লেখ্য, এর ফলে জম্মু-কাশ্মীর তার স্পেশাল স্টেটাস হারায়।
এই প্রসঙ্গে, প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের মন্তব্য ছিল, জম্মু-কাশ্মীরকে যাতে সহজেই ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়, তার জন্যই ৩৭০ নম্বর ধারা প্রয়োগ করা হয়েছিল। যা আদতে ছিল একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা।
সমলিঙ্গ বিবাহ:
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে সমলিঙ্গ বিবাহের ক্ষেত্রে আইনি স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চ। বদলে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি আইনসভার উপরেই ছেড়ে দেয় শীর্ষ আদালত।
সেকশন ৬এ:
প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চই ১৯৮৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ৬এ সেকশনটি বজায় রাখে।
সেই সেকশন অনুসারে, ১৯৭১ সালের আগে যে বাংলাদেশি শরণার্থীরা ভারতে এসেছিলেন, তাঁদের নাগরিকত্ব বহাল রাখে শীর্ষ আদালত। এই রায় অসমের সংশ্লিষ্ট স্বীকৃতিটিকেও রক্ষা করে।
সংশোধনাগারে জাতিভিত্তিক পক্ষপাতিত্ব:
ভারতের সংশোধনাগারগুলির অন্দরে যাতে বন্দিদের সঙ্গে জাতিভিত্তিক পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ না করা হয়, তা নিশ্চিত করতেও বিশেষ রায় দেয় প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ।
সেই রায়ের মাধ্যমে ১০টি রাজ্যকে সংশোধনাগারের অভ্যন্তরীণ নিয়মনীতি বদলে নির্দেশ দেওয়া হয়।
উত্তরপ্রদেশ মাদ্রাসা আইন:
চলতি মাসেই উত্তরপ্রদেশের মাদ্রাসা আইনের বৈধতাকে স্বীকৃতি দেয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। ওই আইনের মাধ্যমেই সে রাজ্যের মাদ্রাসাগুলি পরিচালিত হয়।
উল্লেখ্য, এক্ষেত্রে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট। যে রায়ে বলা হয়েছিল, ২০০৪ সালের ওই আইন অসাংবিধানিক এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের পরিপন্থী।
পুনরায় নিট-ইউজি পরীক্ষা নেওয়ার মামলা:
এবছর প্রশ্নপত্র ফাঁসের জেরে ডাক্তারি পাঠক্রমে সুযোগ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জনের পরীক্ষাটি বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার আবেদন করা হয়। কিন্তু, প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টির বিস্তৃতি সীমাবদ্ধ হওয়ায় সেই আবেদন খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
সাংসদ ও বিধায়কদের রক্ষাকবচ মামলা:
গত মার্চ মাসে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, যদি কোনও সাংসদ বা বিধায়ক অর্থ বা ঘুষের বিনিময়ে ভোটদান এবং বক্তৃতা পেশ করেন, তাহলে সেই সাংসদ বা বিধায়ক কখনই শুনানি এড়াতে রক্ষাকবচ দাবি করতে পারেন না।
বাল্য বিবাহ:
ভারতের সর্বত্রই যাতে বাল্য বিবাহ বন্ধ করার সম্ভব হয়, তার জন্য গত অক্টোবর মাসে একাধিক নির্দেশিকা দেয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ।
২০০৬ সালের বাল্য বিবাহ প্রতিরোধী আইন যাতে সঠিকভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়, তাতেই জোর দেয় আদালত। বলা হয়, বাল্য বিবাহ সংশ্লিষ্ট শিশুদের শৈশবের অধিকার কেড়ে নেয়।