আর চার পাঁচটা দিনের মতোই সারাদিনের কাজ কর্ম সেরে সেই শীতের রাতে বাড়িতে বসে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলেন তাঁরা। ততদিনে ঝিলাম দিয়ে গড়িয়েছে বহু জল। রাজনৈতিক হানাহানি থেকে উস্কানির বহু ছবিই দেখে ফেলেছে স্বপ্ন সুন্দর কাশ্মীর ও তার বাসিন্দারা। এদিকে, ১৯৯০ সালের ১৯ জানুয়ারির রাতে যখন বহু কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবার নিত্যদিনের কাজ, হাসি ঠাট্টা, গল্পে মত্ত, তখনই ধীরে ধীরে আগুন জ্বলতে শুরু করে বরফমোড়া উপত্যকায়। বহু পণ্ডিত বর্ণনা করেন, তাঁদের বাড়ির কাছের এলাকায় যে মসজিদ ছিল সেখান থেকে সেই রাতে যা ঘোষিত হয়েছে, তা তাঁরা স্বপ্নেও কল্পনা করেননি। ততক্ষণে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ভূস্বর্গ ছাড়ার নিনাদ বেজে ওঠে।
ধীরে ধীরে পরিস্থিতি অশান্ত হতে থাকে। আগুন জ্বলতে শুরু করে কাশ্মীরে। উপত্যকা ছেড়ে রাতারাতি চলে যেতে বলা হয় কাশ্মীরি পণ্ডিতদের। কোথায় যাবেন?..কীভাবে যাবেন? আর কেনইবা মাটি ছেড়ে চলে যেতে হবে কাশ্মীরের এই ভূমিপুত্রদের? এই প্রশ্ন অনেকের মধ্যেই জেগে ওঠে। তবে যুক্তি, তর্ক , বিতর্কের সময় তখন হাতে নেই। চারিপাশে রক্তলীলা অব্যাহত তখন। ভূস্বর্গের সেই অভিশপ্ত রাতের স্মৃতি আজও বহু কাশ্মীরি পণ্ডিতের ঘর ছাড়ার যন্ত্রণাকে উস্কানি দেয়। ১৯ জানুয়ারি, ১৯৯০ সালে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ঘর ছাড়ার সেই দিনটির ৩২ বছর পার হয়েছে। তবুও এই বেদনাদায়ক ইতিহাস আজও ঝিলান পাড়ের রাজনীতি থেকে সমাজনীতিতে বহু প্রশ্ন তুলে যায়।
বহু নথির ইতিহাস বলছে, ১৯৪৭ এর স্বাধীনতার পর কাশ্মীর নিয়ে ক্রমাগত সেখানের পাঠানদের উস্কানি দিতে থাকে পাকিস্তান। ধর্মীয় ভেদাভেদে ভর করেই চলেছিল বিচ্ছিন্নতাবাদের উস্কানি। ততক্ষণে কাশ্মীরের রাজা হরি সিং তথা পরবর্তীকালে স্থানীয় সবচেয়ে বড় সংগঠন ন্যাশনাল কনফারেন্স কাশ্মীরের সংকট রোখাকে পাখির চোখ করে দিল্লির মুখাপেক্ষী হন। ১৯৯০ সালে কাশ্মীরে পণ্ডিতদের ঘর ছাড়ার ঘটনার আগে থেকেই উপত্যকায় ধর্মের নামে বিভাজনের রাজনীতি প্রকট হতে থাকে। এদিকে, ১৯৮২ সালে প্রয়াত হন কাশ্মীরের ন্যাশনাল কন্ফারেন্সের দাপুটে নেতা শেখ আবদুল্লাহ। দলের নেতৃত্বের ভার গিয়ে পড়ে পুত্র ফারুক আবদুল্লাহর উপর। এরপর '৮৩ এর ভোটে জয় লাভ করেন ফারুক। তবে তার কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর ও দিল্লির দূরত্ব বাড়তে থাকে। মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হন গুলাম মহম্মদ শাহ। এরপর কাশ্মীর বহু রাজনৈতিক অধ্যার পার করে। দেখে হিংসা, দেখে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। এরপর ফের একবার ফারুক আসীন হন কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী পদে। সাল ১৯৮৬। এরপর ধীরে ধীরে কাশ্মীরের রাজনীতিতে প্রকট হতে থাকেন মুফতি মহম্মদ সইদ। অন্যদিকে জম্মু ও কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট ততদিনে নিজের জাল বিস্তার করতে শুরু করে দেয় উপত্যকার বুকে। কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন করার দাবিতে তারা সরব হয়। ততদিনে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ধীরে ধীরে টার্গেট করা শুরু হয়েছিল বলে দাবি বহু রিপোর্টের। যার ফলশ্রুতি ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাস দেখেছিল।
কাশ্মীরের সন্ত্রাসের সূচনা ১৯৯০ এর বহু আগেই হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮৯ সালে বিজেপি নেতা টিকা লাল টাপলুকে দিনে দুপুরে গুলি করে হত্যা করা হয় শ্রীনগরের বুকে। হত্যা করা হয় , বিচারপতি নীলকণ্ঠ গাঞ্জুকে। তিনিই উগ্রপন্থী নেতা মকবুল ভাটের মৃত্যুদণ্ডে শিলমোহর দিয়েছিলেন। কাশ্মীরের বুকে ততদিনে পর পর হত্যালীলা চলতে থাকে। প্রশ্ন ওঠে প্রশাসনের পদক্ষেপ নিয়ে। জম্মু ও কাশ্মীর থেকে পণ্ডিতদের ঘর ছাড়া নিয়ে তৎকালীন রাজ্যপাল জগমোহনের ভূমিকা নিয়েও বিতর্ক , প্রশ্নের শেষ ছিল না। বহু মহলের অভিযোগ ছিল, সেই সময় পণ্ডিতদের কাশ্মীর ছাড়ার বিষয়ে কিছুটা উদাসীনও ছিল সরকার। তবে সমস্তটাই বিতর্কের বিষয়। এদিকে, নিজের জন্মভিটে ছেড়ে কাশ্মীরি পণ্ডিতরা ধীরে ধীরে দিল্লি, মুম্বই, লখনউতে নিজেদের বসতি গড়ে তোলেন। কেউ থাকতে শুরু করেন রাজস্থানে। কেউ দেশ ছেড়ে চলে যান। তার আগে বহু রাত অনেককেই কাটাতে হয়েছে ত্রাশের তাঁবুতে। তবে ঘরের ফেরার ইচ্ছে , আকাঙ্খা এখনও তাঁদের চলে যায়নি। ২০১৯ সালে মোদী সরকার যখন কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার ঘোষণা করেছিল, তাতে সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন কাশ্মীরি পণ্ডিতরা। তবে তাঁরা ঘরে কবে ফিরবেন, সেই প্রশ্ন এখনও তোলা রয়েছে সময়ের জালে।