জাতীয় সেনা শহিদ দিবসের অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে দেশবাসীকে জরুরি বার্তা দিলেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং লক্ষ্যণীয় বলে মনে করছে রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল।
আজ (মঙ্গলবার -২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫) ঢাকার রাওয়া কনভেনশন হলে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে সেনাপ্রধান সরাসরি সেইসব মানুষকে সতর্ক করেন, যাঁরা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতায় ইন্ধন জোগানোর অপচেষ্টা করছেন এবং বিভাজন ও মেরুকরণের রাজনীতিতে শান দিচ্ছেন। এতে যে আখেরে দেশ এবং দেশবাসীরই ক্ষতি হবে, সেকথা স্পষ্ট ভাষায় বলতে দ্বিধা করেননি সেনাপ্রধান।
বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমে তাঁকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছে, 'আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। পরে বলবেন যে আমি সতর্ক করিনি! আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ না করতে পারেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি-কাটাকাটি করেন, এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আমি আজকে বলে দিলাম, নইলে আপনারা বলবেন যে আমি আপনাদের সতর্ক করিনি!'
হাসিনা সরকারের পতনের পর যেভাবে বাংলাদেশ কার্যত একটি অরাজকতার দেশে পরিণত হয়েছে, তাতে যে তিনি মোটেও খুশি নন, জেনারেলের মন্তব্যে তাঁর স্পষ্ট বার্তা পাওয়া গিয়েছে। তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে - 'আমার অন্য কোনও আকাঙ্ক্ষা নাই। আমার একটাই আকাঙ্ক্ষা - দেশ এবং জাতিটাকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে ছুটি গ্রহণ করা। আই হ্যাড এনাফ লাস্ট সেভেন-এইট মান্থস, আই হ্যাড এনাফ! আমি চাই, দেশ এবং জাতিকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে আমরা সেনা নিবাসে ফেরত আসব!'
সেনাপ্রধান কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন, এত দিন -অর্থাৎ - হাসিনা সকারের পতনের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশে আর কিছু না হোক, একটা স্থিতাবস্থা বজায় ছিল। যা ছিল উন্নয়ন ও অগ্রগতির সহায়ক। কিন্তু, সেই স্থিতাবস্থা বর্তমানে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এবং তার জন্য দেশবাসীকে - অর্থাৎ - নিজেদেরই দায়ী করেছেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান।
তিনি বলেন, 'আরও একটা জরুরি বিষয়, যেটা আমি ভাবলাম যে আপনাদের সঙ্গে আমি শেয়ার করি। দেশের এই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপের পিছনে কিছু কারণ আছে। প্রথম কারণটা হচ্ছে যে আমরা নিজেরা হানাহানির মধ্যে ব্যস্ত, একজন আর একজনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে ব্যস্ত। এটা একটা চমৎকার সুযোগ অপরাধীদের জন্য! যেহেতু আমরা একটা অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে বিরাজ করছি, তারা (অপরাধীরা) খুব ভালোভাবেই জানে যে এই সময়ে যদি অপরাধ করা যায়, তাহলে এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব!'
এদিন সেনাপ্রধানের গলায় শোনা গিয়েছে আত্মসমালোচনা, অনুশোচনা ও হতাশার সুর। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, কয়েক মাস আগে পর্যন্তও পুলিশ-সহ যে সমস্ত বাহিনী একত্রে অনেক ভালো-ভালো কাজ করেছে। আজ তারাই কাজ করতে পারছে না। ভয় পাচ্ছে!
সেনাপ্রধান বলেন, পুলিশ, ব়্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই - এইসব বাহিনী অতীতে দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। 'দেশটাকে যে এত বছর স্থিতিশীল রাখা হয়েছে, এটার কারণ হচ্ছে, এই সশস্ত্র বাহিনীর বহু সেনাসদস্য, সিভিলিয়ন সবাই মিলে এই অর্গানাইজেশনগুলিকে অসামরিক-সামরিক সবাই মিলে, এই অর্গানাইজেশনগুলোকে এফেক্টিভ রেখেছে। সেই জন্য আজকে, এত দিন ধরে আমরা একটা সুন্দর পরিবেশ পেয়েছি।'
প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি দেশের বর্তমান কেয়ারটেকার সরকারের আমলের কার্যকলাপ নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট নন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান? তিনি যদিও তেমনটা কিছু বলেননি। বরং তাঁর দাবি, মহম্মদ ইউনুস সাধ্যমতো দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থে সংস্কারের কাজ করে চলেছেন। আমজনতার প্রতি সেনাপ্রধানের বার্তা, একদিকে ইউনুস প্রশাসনকে সংস্কারের কাজে সাহায্য করতে হবে। আবার, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই অবাধ ও মুক্ত নির্বাচনের পক্ষেও জোরদার সওয়াল করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, 'আমরা দেশে একটা ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশনের জন্য দিকে ধাবিত হচ্ছি এবং তার আগে যেসব সংস্কার করা প্রয়োজন, অবশ্যই সরকার সেদিকে হেল্প করবে। আমি যতবারই ড. ইউনুসের সঙ্গে কথা বলেছি, (হি) কমপ্লিটলি অ্যাগ্রিড উইথ মি। দেয়ার শুড বি ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশন অ্যান্ড দ্যাট ইলেকশন শুড বি উইথইন ডিসেম্বর, অর ক্লোজ টু দ্যাট। যেটা আমি প্রথমেই বলেছিলাম যে, ১৮ মাসের মধ্যে একটা ইলেকশন। আমার মনে হয়, সরকার সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। ড. ইউনুস যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই দেশটাকে ইউনাইটেড রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। ওঁকে আমাদের সাহায্য করতে হবে। তিনি যেন সফল হতে পারেন। সেদিকে আমরা সবাই চেষ্টা করব। আমরা একসঙ্গে ইনশ্আল্লাহ কাজ করে যাব।'