৫ অগস্ট অযোধ্যায় রাম মন্দিরের ভূমিপুজো উপলক্ষে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্পূর্ণ হতে চলেছে গোরক্ষনাথ মঠের মোহন্তদের নেতৃত্বাধীন সুদীর্ঘ মন্দির নির্মাণ আন্দোলনের বৃত্ত।
অযোধ্যার ১৩৭ কিমি পূর্বে অবস্থিত গোরক্ষনাথ মঠ ব্রিটিশ আমল থেকেই রাম মন্দির নির্মাণ আন্দোলনের উৎসকেন্দ্র। বছরের পর বছর এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন মঠের তিন নাথ পন্থী মোহন্ত- দিগ্বিজয় নাথ, অবৈদ্যনাথ ও যোগী আদিত্যনাথ।
১৯৩৫ সালে মঠের মোহন্ত নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে এই আধ্যাত্মিক কেন্দ্রকে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির আখড়ায় রূপান্তরিত করেন দিগ্বিজয় নাথ। ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভায় যোগ দেওয়ার পরে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের উদ্দেশে তিনি হিন্দু সম্প্রদায়কে অনুপ্রাণিত করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি একদল স্বেচ্ছাসেবীকে নিয়ে অযোধ্যা পৌঁছে বলরামপুরের রাজা পটেশ্বরী প্রসাদ সিং এবং ধর্মীয় নেতা স্বামী কর্পত্রী মহারাজের সঙ্গে বৈঠক করেন। তারই ফসল হিসেবে জন্ম নেয় অখিল ভারতীয় রাম রাজ্য পরিষদ পার্টি।
১৯৪৯ সালের ২২ ও ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী গভীর রাতে তদানীন্তন বিতর্কিত সৌধের ভিতরে রামলালার মূর্তি স্থাপন করা হয়। সেই সময় অযোধ্যায় উপস্থিত ছিলেন মোহন্ত দিগ্বিজয় নাথ। স্বেচ্ছাসেবকদের তিনি সেই বিতর্কিত জমিতে পূজার্চনা শুরু করতে উদ্বুদ্ধ করেন। রাজ্য সরকার মসজিদ থেকে রামলালার মূর্তি সরানোর নির্দেশ দিলেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সম্ভাবনার দোহাই দিয়ে তা পালন করেননি তথকালীন জেলাশাসক।
নাথ সম্প্রদায় সংক্রান্ত গবেষক গোরক্ষপুরের এমপি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের অধ্যাপক প্রদীপ রাওয়ের মতে, ‘মসজিদের ভিতরে রামলালার মূর্তি স্থাপন করাই মন্দির আন্দোলনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তারই জেরে আন্দোলনকে রাস্তায়, দরবারে ও সংসদের আঙিনায় পৌঁছে দেন লাখ লাখ ভক্ত ও সাধু-সন্তরা। ১৯৬৯ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সেই আন্দোলনকে জোরদার করে গিয়েছেন দিগ্বিজয় নাথ।’
রাম মন্দির নির্মাণ আন্দোলনকে এর পরে নেতৃত্ব দেন দিগ্বিজয় নাথের যোগ্য উত্তরসূরি মোহন্ত অবৈদ্যনাথ। ১৯৮৪ সালে তিনি শ্রী রাম জন্মভূমি মুক্তি যজ্ঞ সমিতি গঠন করেন এবং তার আওতায় রাম মন্দির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত হিন্দু সংগঠন ও সাধুদের এক মঞ্চে অএনে হাজির করেন। রাম মন্দিরকে স্বাধীন করার উদ্দেশে তিনি ১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিহারের সীতামঢ়ি থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত পদযাত্রার পরিকল্পনা করেন। রাম মন্দিরের সমর্থক দল ও নেতাদের নির্বাচনে জয়লাভ করাতে তিনি ক্রমাগত প্রচার করে যান।
১৯৮৫ সালে কর্নাটকের উদুপিতে আয়োজিত ধর্ম সংসদে অবৈদ্যনাথ এবং দিগম্বর আখড়ার মোহন্ত রামচন্দ্র দাস পরমহংস হিন্দু ভক্তদের পুজোর জন্য বাবরি মসজিদের তালা ভাঙার ডাক দেন। সেই দাবিকে শক্তিশালী করে তুলতে তৈরি হয় অখিল ভারতীয় সংঘর্ষ সমিতি নামে এক কমিটি।
১৯৮৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ফৈজাবাদের জেলাশাসক যখন বাবরি মসজিদের তালা খোলার নির্দেশ দেওয়ার সময় অযোধ্যায় উপস্থিত ছিলেন গোরক্ষনাথ মঠের মোহন্ত অবৈদ্যনাথ।
১৯৮৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দিল্লির জনসভায় রাম জন্মভূমির শিলান্যাস ঘোষণা করেন অবৈদ্যনাথ। পরে ৯ নভেম্বর হরিদ্বারের জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন, রাম মন্দির নির্মাণের জন্য অযোধ্যার উদ্দেশে মিছিল করবেন সাধুরা। তাঁকে নিরস্ত করতে আসরে নামতে হয় তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটা সিং এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নারায়ণ দত্ত তিওয়ারিকে।
এর কয়েক বছর পরে নব্বই দশকের গোড়ায় দিল্লিতে পি ভি নরসিমহা রাওয়ের সঙ্গে দেখা করেন অবৈদ্যনাথের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল। ১৯৯২ সালের ৩০ অক্টোবর দিল্লির ধর্ম সংসদে ঘোষণা করা হয়, ওই বছরের ২ ডিসেম্বর থেকে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের উদ্দেশে করসেবা সংগ্রহ শুরু হবে। আর সেই বছরই রাম মন্দির আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে গোরক্ষপুরে অবৈদ্যনাথের সঙ্গে দেখা করতে পৌঁছন সবে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করা অজয় সিং বিশত, পরবর্তীকালে যাঁকে যোগী আদিত্যনাথ হিসেবে চিনবে সমগ্র দেশ।
অবৈদ্যনাথের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সংসার ত্যাগ করে নাথ পন্থী সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষিত হন আদিত্যনাথ। গুরুর নেতৃত্বে শ্রী রাম জন্মভূমি মুক্তি যজ্ঞ সমিতির বিভিন্ন সভায় তিনি অংশগ্রহণ করতে থাকেন। এই সমস্ত সভায় উপস্থিত থাকতেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, হিন্দু মহাসভার নেতারা ছাড়াও অযোধ্যার সাধুরা।
ক্রমে সভা আয়োজনের প্রধান দায়িত্ব বর্তায় যুবক যোগী আদিত্যনাথের উপরেই। বিভিন্ন হিন্দু সংগঠনের নেতা, সাধু ও পণ্ডিতদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তাঁকে গুরুর কাছে অপরিহার্য করে তোলে। যে কারণে ১৯৯৬ সালে উত্তরসূরি হিসেবে আদিত্যনাথকেই বেছে নেন অবৈদ্যনাথ। এর পর নিজেকে দক্ষ নেতা হিসেবেো প্রতিষ্ঠিত করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি আদিত্যনাথের। তাঁর নেতৃত্বে পূর্ব উত্তর প্রদেশের সভাগুলির মূল উপপাদ্য হিসেবে উঠে আসতে থাকে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ, সমান্তরাল অসামরিক আইন প্রণয়ন, গো-হত্যা নিষিদ্ধকরণ এবং ধর্মান্তর বিরোধী প্রচারের মতো বিষয়গুলি।
১৯৯৮ সালে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন বৃদ্ধ অবৈদ্যনাথ। লোক সভা নির্বাচনে গোরক্ষপুর কেন্দ্রে শিষ্য আদিত্যনাথকেই প্রার্থী মনোনীত করেন চার বার ওই কেন্দ্র থেকে জয়ী অবৈদ্যনাথ। নির্বাচনে জয়লাভ করার পরে সংসদে রাম মন্দির নির্মাণ-সহ একাধিক হিন্দুত্ববাদী দাবি নিয়ে মুখর হন আদিত্যনাথ।
১৯৯৭-৯৮ সালে উত্তর প্রদেশের অন্যান্য প্রান্তে রাম মন্দির আন্দোলনে ভাটা দেখা দিলেও রাজ্যের পূর্ব প্রান্তে একক প্রচেষ্টায় তাকে জীবিত রাখেন যোগী আদিত্যনাথই। এর জন্য গোরক্ষপুর ও আশপাশের জেলায় একাধিক বিস্ভ হিন্দু মহাসম্মেলন ও বিরাট হিন্দু সঙ্গম আয়োজন করেন চিনি। সেই সমস্ত সভায় আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দেন ১০,০০০ সাধু এবং ৯৭০টি হিন্দু সংগঠনের প্রতিনিধিরা। আদিত্যনাথের প্রতি সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেতা অশোক সিঙ্ঘলও।
২০০২ সালে বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে আদিত্যনাথের সম্পর্কের অবনতি ঘটলে তিনি পূর্ব উত্তর প্রদেশে হিন্দু মহাসভাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এ ছাড়া নবীনদের রাম মন্দির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে তাঁরই উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ করে হিন্দু যুব বাহিনী। এই সমস্ত সংগঠন অতি দ্রুত উত্তর প্রদেশের মধ্য ও পূর্বাংশে ছড়িয়ে পড়ে।
২০১৭ সালের ১৯ মার্চ উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বহাল হওয়ার পরে বহু বার অয়োধ্যায় এসেছেন যোগী আদিত্যনাথ। রাজ্য সরকার অযোধ্যাকে পুর নিগম হিসেবে ঘোষণা করেছে, পর্যটক ও তীর্থ ভ্রমণার্থীদের স্বার্থে প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে মন্দির নগরীর। ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে নিয়মিত ভাবে দীপাবলিতে এখানে সাড়ম্বরে আয়োজিত হয়েছে দীপোৎসব। সরযূ নদীর তীরে ২০০ ফিট উঁচু রাম মূর্তি স্থাপনের পরিকল্পনাও করেছে রাজ্য সরকার।
এমনকি কোভিড অতিমারীর মধ্যেও গত ২৫ মার্চ রাম মন্দির নির্মাণের উদ্দেশে অস্থায়ী মন্দিরে রাম লালার মূর্তি প্রতিস্থাপন উৎসবে যোগ দিতে অযোধ্যা সফর করেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। হিন্দু রীতি ও নিয়ম মেনে নিজে হাতে মূর্তিকে এনে বসান অস্থায়ী মন্দিরে। ফের ২৫ জুলাই অযোধ্যায় যান যোগী। এবারের সফর মূলত তাঁর স্বপ্নের রাম মন্দির নির্মাণের আগে ভূমিপুজো অনুষ্ঠান প্রস্তুতির খুঁটিনাটি তদারকি করতে। সেই সঙ্গে অযোধ্যায় অন্যান্য সরকারি প্রকল্পও পরিদর্শন করেন মুখ্যমন্ত্রী।
বুধবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গী হয়ে আবার সরযূতীরে উপস্থিত হবেন যোগী আদিত্যনাথ। ভূমিপুজোর মাধ্যমে তাঁর হাতেই পূর্ণতা পাবে রাম মন্দির আন্দোলন, যার সূত্রপাত করেছিলেন গোরক্ষনাথ মঠে তাঁরই উত্তরসূরি মোহন্তরা।