ফৌজদারি মামলায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতারে পূর্বানুমতি নেওয়ার বিধান বাতিলকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন বাংলাদেশের প্রাক্তন শীর্ষ আমলারা৷ তাঁরা মনে করেন, এর ফলে সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে সমস্যা হবে না৷
আর আইন বিশ্লেষকরা মনে করেন, ‘আইনটির সুবিধা পাচ্ছিলেন অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা৷ আইনটি ছিল সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷’ তবে অ্যাটর্নি জেনারেল হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন৷ মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ আছে৷
আইনটি কী এবং কেন বাতিল
বাংলাদেশে সরকারি চাকরি আইনটি করা হয়েছিল ২০১৮ সালে৷ আর আইনের ৪১(১) ধারায় বলা হয়েছে সরকারি কর্মচারীদের ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতার করতে হলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নিতে হবে৷ টিআইবি এবং দুদক শুরু থেকেই আইনটির বিরোধিতা করে আসছিল৷ আইনের এই ধারাটি চ্যালেঞ্জ করে ২০১৯ সালে হাইকোর্টে রিট করেন মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রধান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ৷
কয়েক দফা শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট ওই বিধানটি বাতিল করে দেয়৷ বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজি মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায়ে বলেন, ‘২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনের ৪১(১) ধারায় ফৌজদারি মামলায় সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়ার বিধানটি ‘সংবিধান পরিপন্থী' এবং ‘মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী'।
আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘এই বিধানটি সরকারি কর্মচারীর বিশেষ সুবিধা দিয়েছিল৷ কিন্তু সংবিধানে আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান৷ আইনের আশ্রয় পাওয়ার এবং আইন প্রয়োগে কোনও বৈষম্য করার সুযোগ নেই৷ ক্রিমিনাল জুরিসপ্রুডেন্সের মূল কথা হল, একই অপরাধে সবার জন্য একই ব্যবস্থা৷ এক-একজনের জন্য এক-এক বিধান হতে পারে না৷ এটা একটা বৈষম্যমূলক আইন৷’
তিনি বলেন, ‘দুদক আইনকেও এই আইনটি বাধাগ্রস্ত করেছিল৷ কারণ, দুদকের আইনে বলা আছে অন্য আইনে যা-ই থাকুক না কেন দুদক আইন প্রাধান্য পাবে৷ দুদক আইনের পর ওই আইনটি করে দুদক আইনকে খর্ব করা হয়৷ দুদকের ওই ক্ষমতার ৩২(ক) ধারা বাতিল করে এই আইন করে সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছিল৷’
দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম বলেন, ‘দুদকের ৩২(ক) বাতিল করে এই আইনটি করার ফলে আমরা ঠিকমতো কাজ করতে পারতাম না৷ উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলা স্থগিত হয়ে যেতে৷ এটা বৈষম্যমূলক আইন ছিল৷ এই আইনের কারণে দুর্নীতিবাজরা সুবিধা পেত৷ এ কারণে এই রিটে আমরাও পার্টি হয়েছিলাম৷’
আরও পড়ুন: Bangladesh Fuel Crisis: সপ্তাহে দু'দিন বন্ধ স্কুল-কলেজ, অফিসের সময়ও কমল, নেপথ্যে কী?
দায়িত্ব পালনে কোনও বাধা হবে?
আইনটি বাতিলের ফলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দায়িত্ব পালন করে গিয়ে কোনও বাধার মুখে পড়বেন কিনা, সেই প্রশ্নও উঠেছে৷ এর জবাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রাক্তন সচিব আলি ইমাম মজুমদার বলেন, ‘দায়িত্ব পালনের সময় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইনি প্রোটেকশন দেওয়ার ব্যবস্থা ফৌজদারি কার্যবিধিতেই (সিআরপিসি) আছে৷ সেখানে বলা আছে, দায়িত্ব পালনকালে তাদের বিরুদ্ধে কোনও ফৌজদারি ব্যবস্থা নিতে হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে৷ নতুন করে এই আইনটির কোনও প্রয়োজন ছিল না৷ এখন এই আইনটি বাতিল হওয়ায় কোনও অসুবিধা বা দায়িত্ব পালনে বাধা হবে না৷’
সিআরপিসির ১৯৭ ধরায় বলা আছে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মকর্তা কোনো সরকারি দায়িত্ব পালনকালে কোনও অভিযোগে অভিযুক্ত হলে সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনও আদালত সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিতে পারবেন না৷ কোন আদালতে এই মামলার বিচার হবে, তা সরকার নির্ধারণ করে দেবে৷
প্রাক্তন সচিব র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, ‘আইন যথাযথ প্রয়োগের বিধান হল, কোনও অপরাধের যদি প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায় তাহলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ সেটা হলে সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেফতারে কোনও বাধা থাকার কথা নয়৷ আমার বিবেচনায় আদালত সঠিক সিদ্ধান্তই দিয়েছে৷ তবে পৃথিবীর দেশে দেশে বিধান আছে যে, সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেফতারের আগে সরকারের পূর্বানুমোদন নেওয়া হয়৷ এইটুকু প্রোটেকশন না থাকলে তাঁরা তো নির্বিঘ্নে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না৷’
তাঁর কথা, ‘একটা ব্যালেন্স থাকতে হয়৷ এখন পূর্বানুমোদনের বিধান থাকায় সরকারি কর্মকর্তা মনে করছেন- আমি কী একটা হয়ে গেছি,যা খুশি তাই করবে। আবার সরাসরি গ্রেপ্তারের বিধান থাকলে ইচ্ছে হলেই গ্রেফতার করা হবে৷ আমার কথা হল, নিশ্চিত হয়ে গ্রেফতার করতে হবে৷ সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গ্রেপ্তার করা যাবে না৷’
আরও পড়ুন: Bangladesh: ‘অশ্লীল নজর অসভ্যতা’, পোশাক বিতর্কের জেরে প্রতিবাদে সামিল তরুণীরা
খুরশিদ আলম মনে করেন, ‘এই আইনটি বাতিল হওয়ায় যাঁরা দুর্নীতিবাজ, তাঁদের ভয়ের কারণ আছে৷ কিন্তু যাঁরা সৎ এবং আইন মেনে কাজ করেন- তাদের কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়৷ দুর্নীতি করবেন আবার আপনাকে গ্রেফতারও করা যাবে না- এটা তো কোনও আইন হতে পারে না৷’
মনজিল মোরসেদের মতে, ‘এই আইনটি দুর্নীতি সহায়ক ছিল৷ দুর্নীতির সুযোগ করে দেয়া কোনো আইন তো থাকতে পারে না৷ আর বৈষম্যমূলক আইন তো সংবিধান অনুমোদন করে না৷’
(বিশেষ দ্রষ্টব্য : প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া হয়েছে। সেই প্রতিবেদনই তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার কোনও প্রতিনিধি এই প্রতিবেদন লেখেননি।)