বাংলা নিউজ > ঘরে বাইরে > Bangladesh: গুলিস্তানের ভবনে ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা ছিল না কেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় উঠছে প্রশ্ন

Bangladesh: গুলিস্তানের ভবনে ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা ছিল না কেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় উঠছে প্রশ্ন

গুলিস্তানের ভবনে ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা ছিল না। ছবি চ্যানেল আই

ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির বেসমেন্টে বড় একটি সেনেটারি দোকান, নিচ তলায় পাঁচটি দোকান, দোতলায় দুটি দোকান ছিল। এসব দোকানের বেশিরভাগ কাঁচ ও পাওয়ারফুল এসি ব্যবহার করা হয়। এসিগুলো ২০১০ সাল থেকে সার্ভিসিং করা হয়নি। এসি ত্রুটিপূর্ণ থাকলে তা থেকেও বিস্ফোরণ হতে পারে।

গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে কুইন স্যানিটারি মার্কেটে বিস্ফোরণের প্রাথমিক কারণ হিসেবে ভবনে ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা না থাকাকেই দায়ী করছেন তদন্তকারীরা। এর ফলে গ্যাসে জমে ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে বলে মনে তাঁদের অনুমান। ঢাকার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আহত এবং আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন।

পুরো ভবনে আবাসিক গ্যাস, ছিল না ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা

তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ভবনে আগের হোটেলের রান্নাঘরের গ্যাসের লাইনটি ছিন্ন করা হলেও পুরো ভবনে ছিল আবাসিক গ্যাস লাইন। বেসমেন্টে পার্কিংয়ের কথা থাকলেও সেখানে বাংলাদেশ সেনেটারি নামে একটি কমার্শিয়াল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রায় ১৮০০ স্কয়ার ফিটের এ আন্ডারগ্রাউন্ডটি পুরোটাই কাঁচে ঘেরা।

সেখানে ছিল না কোনও ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা। বড় দু’টি এসির মাধ্যমে ঠান্ডা রাখা হতো দোকানটি। সাততলা ভবনের কোথায় সুয়ারেজ সেপটিক ট্যাংক অবস্থিত সে বিষয়ে ভবনের মালিকরাও সঠিক তথ্য দিতে পারেননি। ধারণা করা হয়, উত্তর দিকের ভবনের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের যে আড়াই থেকে তিন ফিট গলি রয়েছে, সেখানে একইসঙ্গে দুটি ভবনের সেপটিক ট্যাংকি অবস্থিত।

সাততলা ভবনের বেসমেন্ট-সহ তিনটি ফ্লোরের কমার্শিয়াল লোকজন, আবাসিকদের লোকজনের বর্জ্য যেখানে জমা হয়, অনেক দিন ধরে সেই জায়গা পরিষ্কার না করায় বায়োগ্যাস জমতে পারে। যা থেকে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে। একসময় বেসমেন্টের রান্নাঘরে কমার্শিয়াল বড় লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হতো। যদিও পরে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু বাড়ির অন্যান্য ফ্লোরের ডোমেস্টিক লাইন এখনও চলমান। ফলে এ লাইন সম্পূর্ণ বন্ধ না হয়ে সেখান দিয়েও তিতাস গ্যাস লিক হতে পারে। কোনও ভাবে জমা গ্যাসে স্পার্কের মাধ্যমে বিস্ফোরণের হতে পারে পারে বলেও ধারণা করছেন তদন্তকারীরা। ডিবির তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, বেজমেন্টে কার পার্কিং থাকলে ভেন্টিলেশন থাকত। কোনও গ্যাস জমা হতো না। বিস্ফোরণের ঘটনাটিও ঘটত না।

ভবনের গলিতে সেপটিক ট্যাংক ও এসির আউটার

মূল ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ও তার উত্তর দিকে ব্র্যাক ব্যাঙ্কের ভবনের মাঝখানে সরু একটি গলি আছে। এ গলিতে বর্জ্যের সেপটিক ট্যাংক, এসির আউটার রয়েছে। বিস্ফোরণে সেপটিক ট্যাংকের পাশের দেয়ালগুলো সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্জ্যের বায়োগ্যাসের বিস্ফোরণেও এমনটি হতে পারে।

ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির বেসমেন্টে বড় একটি সেনেটারি দোকান, নিচ তলায় পাঁচটি দোকান, দোতলায় দুটি দোকান ছিল। এসব দোকানের অনেক কাঁচ ও পাওয়ারফুল এসি ব্যবহার করা হয়। এসিগুলো ২০১০ সাল থেকে সার্ভিসিং করা হয়নি। এসি ত্রুটিপূর্ণ থাকলে তা থেকেও বিস্ফোরণ হতে পারে।

ডিবি জানিয়েছে, ভবনটি কোনও পরিত্যক্ত পাবলিক স্পেস নয়, এটি ব্যক্তি মালিকানাধীন। বিভিন্ন স্যানিটারির ও সিসি ক্যামেরার সার্ভিলিয়েন্স ছিল। ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির জন্য যে পরিমাণ বিস্ফোরক প্রয়োজন তা এখানে সবার অজান্তে জমা রাখাও প্রায় অসম্ভব।

ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশীদ বলেন, বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট তদন্ত করছে। বিভিন্ন দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা প্রতিবেদন দিলে বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ জানা যাবে। তবে এখনও পর্যন্ত বিস্ফোরক বা স্যাবোট্যাজের কোনও চিহ্ন সেখানে পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সিসি ক্যামেরা ছিল। এসবের ডিভিআর থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে। ভবনের ও দোকানের মালিকদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিস্ফোরণের কারণ জানা চেষ্টা চলছে।

ভবনটি নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি

ডিবি প্রধান বলেন, কুইন সেনেটারি মার্কেট ভবনটি নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। এটা রাজউকের দেখা উচিত ছিল- অনুমতি নিয়ে বিল্ডিং কোড মেনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল কিনা। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী কুইন সেনেটারি মার্কেটের বেজমেন্টে বিস্ফোরণের উৎসস্থল উল্লেখ করে তিনি বলেন, বেজমেন্টের এই আন্ডারগ্রাউন্ড স্পেসটি রাজউকের বিধান অনুসারে খোলামেলা থাকলে সেখানে কোনও ত্রুটি দেখা দিলে তখনই উদ্যোগ করা যেত। বায়োগ্যাস-সহ অন্যান্য সমস্যারও সমাধান করা যেত। বাড়ির মালিকরা টাকার লোভে আন্ডারগ্রাউন্ডকে এক সময় রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেই রান্নাঘরের গ্যাসের লাইন যথাযথভাবে অপসারণ না করে তার ওপরেই সম্পূর্ণ এয়ারটাইট এসি করা নির্মাণ সামগ্রীর মার্কেট বানিয়ে দিয়েছেন।

লোভ, অবহেলার ফল

হারুন বলেন, দোকানের মালিক বিল্ডিং কোড না মেনে ভাড়া নিয়ে বেজমেন্টের ১ ইঞ্চি জায়গাকেও ফাঁকা না রেখে ডেকোরেশন করে দোকান বানিয়ে সেখানেই তার কর্মচারী ও ক্রেতা সাধারণের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন। এতোগুলো প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ভবনের মালিক এবং দোকানদারের স্বেচ্ছাচারিতা, লোভ এবং অবহেলারই ফল।

ডিবির এ কর্মকর্তা বলেন, যারা ভবনটি থেকে ট্যাক্স আদায় করেন তাদের উচিত ছিল যাদের ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে ট্যাক্স নিচ্ছেন, তারা বিল্ডিং কোড ফলো করছে কিনা সেটা জানা। ভবন ও দোকান মালিক, বাসিন্দাদের তো দায় ছিলই। রাজউক ও সিটি কর্পোরেশনেরও উচিত ছিল ঠিকঠাক তদারকি করা।

গ্রেফতার ৩

ভয়াবহ এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও ডিবি প্রধান জানান। বিস্ফোরণে ২১ জনের প্রাণহানির ঘটনায় ভবনের মালিক ওয়াহিদুর রহমান, মতিউর রহমান ও ভবনের বেজমেন্টের স্যানিটারি ব্যবসায়ী আব্দুল মোতালেব মিন্টুকে প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের আনা হয়। পরে তাদের আটক ও পরে অবহেলাজনিত একটি মামলা দিয়ে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। আদালতে তাদের বিরুদ্ধে রিমান্ড চাওয়া হবে। সেখানে তাদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলেও জানান ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশীদ।

জানা যায়, ১৯৯২ সালে নির্মিত ভবনটি ছিল একতলা। সেখানে কুইন ক্যাফে নামে একটি রেস্তোরাঁ ছিল। এর রান্নাঘর ছিল ভবনের বেজমেন্টে। রান্নাঘরে ছিল আবার কমার্শিয়াল গ্যাসের বড় লাইন; যা পরে লিখিত আকারে তিতাসের কাছে সমর্পণ করা হয়।

২০০৪ সালে ভবনটি ৭ তলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়। ভবনের প্রকৃত মালিক হাজী মোহাম্মদ রেজাউর রহমান। ২০১১ সালে তার মৃত্যুর পর ওয়ারিশ সূত্রে ভবনের বর্তমান মালিক তার স্ত্রী, ও পাঁচ ছেলে-মেয়ে (তিন ছেলে-দুই মেয়ে)।

মঙ্গলবার ৭ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে ‘ক্যাফে কুইন’ নামে সাততলা ভবনের নিচতলায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এসময় পাশাপাশি থাকা দুটি ভবন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বন্ধ করুন