অশান্তির আবহেই এবার বাংলাদেশে সংবিধান সংস্কার করতে প্রস্তাব দিল কমিশন। এই কমিশন সংবিধান সংস্কার করার ক্ষেত্রে খসড়া প্রতিবেদনও জমা দেয়। মহম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আজ বুধবার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সংবিধান সংস্কারে নিযুক্ত কমিশন। আর ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ক্ষমতা কাঠামো, সংসদের ধরন–সহ নানা ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রস্তাব সেখানে রয়েছে বলে সূত্রের খবর। তিন মাস ধরে সাধারণ নাগরিক, রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য সংস্থার কাছ থেকে মতামত সংগ্রহ করেছে কমিশন। এক লাখ লোকের মতামত গ্রহণ–সহ নানা দেশের সংবিধানও পর্যালোচনা করা হয়েছে। পাঁচ খণ্ডের প্রতিবেদন প্রস্তুত করে জমা দেওয়া হয়েছে বলে কমিশন সূত্রে খবর।
প্রথম খণ্ডে সুপারিশ এবং সুপারিশগুলির যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছে। আর বাকি চার পর্যায়ে নানা প্রাপ্ত মতামত রাখা হয়েছে। সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. আলি রিয়াজ জানান, সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবনা তৈরির ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ, ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টন, জবাবদিহি, রাষ্ট্র পরিচালনায় সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলিকে তুলে ধরেছেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘কিছু মতভেদ থাকতেই পারে। তবে সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের বিষয়ে আমি আশাবাদী।’ বাংলাদেশে এখন যেভাবে হিন্দুদের উপর আক্রমণ নেমে আসছে সেটা এখন গোটা বিশ্বে চর্চিত হচ্ছে। সেখানে সংবিধানের সংস্কার তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রথম প্রস্তাব–ক্ষমতার ভারসাম্য: বাংলাদেশের সংবিধান এখনও পর্যন্ত ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। দ্বাদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পুনরায় প্রবর্তন করা হয়। সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. আলি রিয়াজ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী দলের প্রধান হিসেবে দল চালান। সংসদের নেতা হিসেবে তিনি সংসদের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখেন এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী হন এবং এমন প্রধানমন্ত্রী, তিনি যা বলবেন রাষ্ট্রপতিকে তা শুনতেই হবে। সেখানে অন্যথার কোনো জায়গা নেই।’ সংবিধানের মধ্যেই ‘ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের পথ’ রয়েছে বলে মনে করেন রিয়াজ।
এখানের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার কথা বলে আসছে। তবে সংস্কার কমিশন ভারসাম্য আনতে চাইছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভিতর দিয়ে। এই বিষয়ে সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. আলি রিয়াজ বক্তব্য, ‘আমাদের বিবেচনা করতে হবে যে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করতে পারি কিনা। জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে নিয়োগ করার পদ্ধতি কি তৈরি করা যায়?’ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে যে কাঠামো দরকার সেটা প্রস্তাবনায় থাকছে। আইনসভার সরকার এবং বিরোধী উভয়পক্ষকে সম্পৃক্ত করার কথা আছে।
আরও পড়ুন: কাঁথি সমবায় ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনা চরমে, বক্সিকে ফোনে নির্দেশ মমতার
দ্বিতীয় খণ্ডে, সংসদ: দুই কক্ষ, পাঁচ শতাধিক আসন, নারী আসনেও ভোট করার কথা বলা আছে। এখন বাংলাদেশের এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত আসন–সহ মোট ৩৫০টি আসন রয়েছে। সংসদের নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যা বেড়ে ৪০০ করার প্রস্তাব হচ্ছে। উচ্চকক্ষে আরো ১০৫টি আসন যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। নিম্নকক্ষের ৪০০ আসনের ১০০টি নারী আসন। তাঁদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. আলি রিয়াজের কথায়, ‘বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষ ছিল। এখন আঠারো কোটি মানুষ। তাঁদের প্রতিনিধিত্বের জায়গা করতে হবে। আরও ছোট ছোট কেন্দ্র তৈরি করতে পারলে মানুষ সরাসরি যুক্ত হতে পারবে।’
সাধারণ নির্বাচনে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের হার অনুযায়ী, উচ্চকক্ষে আসন পাবে দলটি। সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. আলি রিয়াজ বলেন, ‘সকলের প্রতিনিধিত্বের একটা পথ তৈরি হবে। উচ্চকক্ষ এবং নিম্নকক্ষের মধ্যে ক্ষমতার এক ধরনের ভারসাম্য থাকবে। তারা নিঃসন্দেহে একটা ভূমিকা পালন করবে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে কত হাজার কোটি টাকা খরচ করা হল। আজ যদি আগামীর জন্য দেশের প্রয়োজনে কিছু অর্থ ব্যয় করি, সেটা ভবিষ্যতের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য ব্যয় করা হবে।’ তিন খণ্ডে, ৭০ অনুচ্ছেদ: এখানে বলা হয়েছে—কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনীত হয়ে কোনও ব্যক্তি যদি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, তিনি যদি নিজ দল থেকে পদত্যাগ করেন, অথবা সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহলে সংসদে তার আসনটি আসন শূন্য হবে।’
চার খণ্ড, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: বিচারবিভাগ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হয়েছিল ২০০৭ সালে। রাজনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভাব মুক্ত করার উদ্দেশে তা করা হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের খসড়া প্রতিবেদনে বিচারবিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় তৈরির সুপারিশ করেছে। সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. আলি রিয়াজের বক্তব্য, ‘বিচারবিভাগে আর্থিক বরাদ্দ সরাসরি স্বতন্ত্র তহবিল থেকে নিয়ে আসার প্রস্তাব থাকছে।’ পাঁচ খণ্ড, স্থানীয় সরকার: বাংলাদেশে প্রায় এক দশক ধরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় প্রতীকে হয়ে আসছিল। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকার নির্ভর হয়ে পড়েছে। সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. আলি রিয়াজ জানান, ‘তাদের বাজেট পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে নির্বাহী বিভাগ এতটাই নিয়ন্ত্রণ করে যে স্থানীয় সরকারের পক্ষে কিছু করা সম্ভব হয় না।’