বাংলাদেশের প্রস্তাবিত বাজেটে আয়কর রিটার্ন দাখিল করলে করযোগ্য আয় না থাকলেও ন্যূনতম ২,০০০ টাকা কর দিতে হবে। এটা নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত আছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা অনৈতিক এবং কর নীতির সঙ্গে খাপ খায় না।
কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলছে, এতে আয়কর দেওয়া লোকের সংখ্যা বাড়বে। আর যে ৪২টি পরিষেবা নিতে টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, সেই পরিষেবা যাঁরা নেন, তাঁদের বছরে ২,০০০ টাকা কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে।
এবার ব্যক্তিগত আয়ের করমুক্ত সীমা তিন লাখ থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। উল্টো দিকে ধনী করদাতাদের সারচার্জ মুক্ত আয়ের সীমা তিন কোটি থেকে বাড়িয়ে চার কোটি টাকা করা হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন এখানে স্পষ্ট যে যাঁরা ধনী, তাঁদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
প্রায় ১৭ কোটি জনংখ্যার এই দেশে সরকারি হিসেবে বর্তমানে টিআইএনধারী করদাতার সংখ্যা প্রায় ৮৮ লাখ। কিন্তু আয়কর রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা ৩২ লাখ। সেই হিসাবে টিআইএনধারী মোট জনসংখ্যার পাঁচ ভাগ। আর রিটার্ন দাখিল করে মোট জনসংখ্যার শতকরা দুই ভাগ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘২০১৮ সালে আমরা একটা সমীক্ষায় দেখেছি বাংলাদেশে বছরে কোটি টাকা আয় করেন এরকম জনগোষ্ঠীর ৬৭ শতাংশ কর আওতার বাইরে আছে। এরা যে লার্জ ট্যাক্সপেয়ার ইউনিটের মধ্যে তা নয়। এরা সারাদেশেই ছড়িয়ে আছেন। কিন্তু এদের করের আওতায় আনা যাচ্ছে না।’
তাঁর কথায়, ‘আমরা বলছি, যারা ট্যাক্স দেওয়ার যোগ্য, তাদের করের আওতায় আনতে হবে। যারা ট্যাক্স ফাঁকি দেন, তাদের কাছ থেকে ন্যায্য কর আদায় করতে হবে। কিন্তু সরকার করমুক্ত আয় সীমা তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা করার পর আবার করযোগ্য আয় না থাকলেও ২,০০০ টাকা করের প্রস্তাব ওই নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং অনৈতিক। এনবিআরকে দক্ষতার সঙ্গে করযোগ্যদের খুঁজে বের করতে হবে। একদিকে গরিব মানুষের জন্য এটা করা হচ্ছে, অন্যদিকে যারা ধনী এবং সম্পদশালী যারা, তাদের সারচার্জমুক্ত আয়সীমা তিন কোটি থেকে বাড়িয়ে চার কোটি টাকা করা হয়েছে। এটা কি তাহলে গরিব মানুষের বিপরীতে ধনীদের সুবিধা দেওয়া হল? ন্যায্যতার বিচারে এটা গ্রহণযোগ্য নয়।’
বাংলাদেশে এনবিআরের দুর্নীতি এবং অদক্ষতা রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পথে প্রধান বাধা। এখানে মোট রাজস্বের ৩৫ ভাগ আসে আয়কর বা ডিরেক্ট ট্যাক্স থেকে। আর বাকি ৬৫ ভাগ আসে ভ্যাট-সহ অন্যান্য ইন-ডিরেক্ট ট্যাক্স থেকে। এটা একটি বড় দুর্বলতা। আয়কর থেকে সবচেয়ে বেশি আদায় হওয়া উচিত বলে মনে করেন খন্দকার গেলাম মোয়াজ্জেম।
এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে জনসংখ্যার অনুপাতে আয়কর দাতার সংখ্যা খুবই কম। এই অনুপাতে আমরা এশিয়ায় সবার পিছনে আছি। দেশে প্রচুর লোক আছেন যারা কর দেওয়ার যোগ্য হলেও দেন না। শুধু শহরে নয়, এখন গ্রামেও দেখবেন সুন্দর-সুন্দর ভবন ও বাড়িঘর। তারা কি আয়কর দেন? তাই আমি মনে করি এই যে ২,০০০ টাকার বিধান, এটা আয়কর দাতা বাড়াতে কাজে লাগাতে হবে। মানুষ টিআইএন খুলবেন। কিন্তু তাকে সম্মানিত করতে হবে। ২,০০০ টাকা দিলে ধরুন ৫০০ টাকা তাকে রেয়াত দিতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে আয়কর দেওয়া গর্বের। তাই ২,০০০ টাকা নিয়ে আমি সমালোচনার কিছু দেখি না। আসল কথা হল, যোগ্য আয়কর দাতাদের ট্যাক্স নেটের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এবার ৬৭ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে এনবিআরকে। আইএমএফ জিডিপির তুলনায় কর আদায়ের অনুপাত ৭.৮ থেকে বাড়িয়ে ৯.৫ শতাংশে উন্নীত করার শর্ত দিয়েছে।
কিন্তু সেটা কি এই ২,০০০ টাকা দিয়ে হবে? প্রতি বছরই এএনবিআর রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসেবে চলতি অর্থবছরের (২০২২-১৩) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হতে পারে ৫৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন: 'রাজের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক নেই... বিচ্ছেদ তো হয়েই গেছে', পঞ্চম বিয়েও ভাঙল পরীমনির!
আর এই ঘাটতির পিছনে আছে কর ফাঁকি, কর না দেওয়া। এর সঙ্গে এনবিআরের অদক্ষতা আর দুর্নীতির বিষয়ও যুক্ত। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক গবেষণায় দেখেছে ২০০৯-১০ এক অর্থবছরেই ২১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘একটি শ্রেণি ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে কর ফাঁকি দেয়। আবার এনবিআর অদক্ষতার কারণেও কর ফাঁকি ধরতে পারে না। তাই কর্পোরেট লেনদেন যদি কেন্দ্রীয় একটি ডিজিটাল সিস্টেমের অধীনে আনা যেত, অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নীতির মধ্যে আনা যেত তাহলে এই কর ফাঁকি রোধ করা যেত।’
গোলাম হোসেন বলেন, ‘ব্যাঙ্ক ঋণ নেওয়ার সময় আয় বেশি দেখায়। কর দেয়ার সময় আয় কম দেখায়। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের অনেক বড় বড় বেতনধারী বেতনের একটি অংশ ক্যাশে নিয়ে আয়কর ফাঁকি দেয়। আর প্রতিষ্ঠানও খরচ এবং আয় কম দেখায়।’
সিরডাপের পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মহম্মদ হেলালউদ্দিন বলেন, 'আয়কর হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে । যার বেশি আয়, তিনি বেশি কর দেবেন। যার আয় কম, তিনি কম কর দেবেন। যার করযোগ্য আয় নেই. তিনি কেন কর দেবেন? যে ৪২ ধরনের সেবার কথা বলা হচ্ছে সেটা নিতে গেলে তো কর দিতেই হয়। কিন্তু ২,০০০ টাকার বিধানের মধ্য দিয়ে ওই সেবা নিতে আলাদাভাবে যোগ্য হতে হবে কেন? সাধারণ মানুষ তো এমনিতেই কর দেয়। খাবার কিনলে ভ্যাট দেয়। তেল কিনলে দেয়। সাবান কিনলে দেয়।'
আরও পড়ুন: Bangladesh Heatwave: ওপার বাংলাতেও ভয়াবহ তাপপ্রবাহ, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং, বন্ধ করা হল স্কুল
তার কথা, 'বাংলাদেশের শীর্ষের ১০ ভাগ লোকের হাতে জাতীয় আয়ের ৩৫ ভাগ। তারা যদি কমপক্ষে ১০ শতাংশ করও দেয়, তাহলে তো জিডিপির অনুপাতে ৩.৫ শতাংশ কর সেখান থেকে আসার কথা। সেটা তো আসছে না। তার মানে যারা অনেক হাই ইনকামের তাদের আমরা ট্যাক্স নেটের আওতায় আনতে পারি নাই। আর সেই কারণে আমি নির্বিচারে সবার কাছ থেকে দুই হাজার করে কর নেব?'
তিনি বলেন, ‘তিন লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি বছরে আয় হলেই এখন আয়কর দিতে হবে। মাসে আয় ৩০ হাজার টাকা। মূল্যস্ফীতির এই সময়ে এই টাকা দিয়ে মাসে পরিবার নিয়ে চলাই তো অনেক কঠিন।’
(বিশেষ দ্রষ্টব্য : প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া হয়েছে। সেই প্রতিবেদনই তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার কোনও প্রতিনিধি এই প্রতিবেদন লেখেননি।
(এই খবরটি আপনি পড়তে পারেন HT App থেকেও। এবার HT App বাংলায়। HT App ডাউনলোড করার লিঙ্ক https://htipad.onelink.me/277p/p7me4aup)