সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। কে তিনি? কীভাবেই বা সিরিয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতা দখল করলেন তিনি? আপাতত সর্বত্রই এ নিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়েছে।
কে বাশার আল-আসাদ?
তথ্য বলছে, বাশার আল-আসাদের পরিবার আদতে সিরিয়ার সবথেকে ক্ষমতাশালী ও স্বৈরাচারী একটি পরিবার। যারা গত প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে সিরিয়ার মানুষকে শাসন করে এসেছে। বাশার আল-আসাদ হলেন সেই পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের সদস্য।
তথ্যাভিজ্ঞ মহলের দাবি, তাঁর বাবার মতো বাশার আল-আসাদও সিরিয়াজুড়ে এক স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করেছিলেন। কিন্তু, ২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের কারণে তাঁকে সমস্যায় পড়তে হয়। একইসঙ্গে, দেশবাসীর জীবনও অতীষ্ট হয়ে ওঠে।
উপরন্তু, সিরিয়ায় এহেন অস্থিরতার জেরে আইএসআইএস-এর মতো কট্টরপন্থী ইসলামি সংগঠন ও জঙ্গি সংগঠনগুলি সিরিয়ার মাটিতে জন্ম নিতে ও বেড়ে উঠতে শুরু করে। প্রাণ ভয়ে সিরিয়ার নাগরিকদের একটা বড় অংশ অন্যান্য দেশে পালাতে শুরু করেন। ফলত, আন্তর্জাতিকভাবে শরণার্থী সমস্যা বাড়তে থাকে।
আরব বসন্তের জেরে সিরিয়ায় গণতন্ত্রকামী আন্দোলন শুরু হলেও আসাদের সরকার তার সামনে মাথানত করতে অস্বীকার করে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করতে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। যার ফলস্বরূপ - প্রথম কয়েক মাসের মধ্যেই হাজার হাজার মানুষকে হয় খুন করা হয়, আর না হলে হাজতে ভরা হয়।
গত প্রায় ১৩ বছর ধরে এই গৃহযুদ্ধে নাজেহাল সিরিয়ার মানুষ। এই ১৩ বছর লাগাতার আসাদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। এমকী, আমজনতার বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের মতো গুরুতর অভিযোগও উঠেছে আসাদ-বাহিনীর বিরুদ্ধে।
পরিস্থিতি যাতে আরও খারাপ না হয়, তা নিশ্চিত করতে আমেরিকা, জর্ডন, তুরস্ক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফে গৃহযুদ্ধের একেবারে প্রথম থেকেই আসাদকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু, তিনি রাজি হননি।
এরপর পশ্চিমের দেশগুলি কার্যত একযোগে আসাদ ও তাঁর সরকারকে একঘরে করে দেয়। কিন্তু, তা সত্ত্বেও এত দিন ক্ষমতায় টিকে থেকেছেন আসাদ। তার প্রধান কারণ হল - তাঁর প্রতি ইরান ও রাশিয়ার সমর্থন। এবং দেশের অভ্যন্তরে বিরোধীপক্ষকে বাগে রাখতে চূড়ান্ত দমন-পীড়ন।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে, সিরিয়ার আমজনতা আসাদ ও তাঁর সরকারের উপর এতটাই বীতশ্রদ্ধ ছিল যে, গত কয়েক দিনে বিদ্রোহীরা একে একে বিভিন্ন শহর দখল করতে শুরু করার পর সেখানকার বাসিন্দারা আনন্দ-উল্লাসে সামিল হন। তাঁদের বাশার আল-আসাদ ও তাঁর বাবার ছবি ছিঁড়ে ফেলতে দেখা যায়।
কীভাবে ক্ষমতা দখল করলেন বাশার আল-আসাদ?
বাশার আল-আসাদ সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করেন ২০০০ হাজার সালে। তাঁর বাবা হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন বাশার আল-আসাদ।
হাফিজ নিজে দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছিলেন এবং তিনি ছিলেন বাথ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। হাফিজ সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করেন ১৯৭০ সালে। এবং তার পরের বছর তিনি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
২০০০ সালে হাফিজের মৃত্যুর পর নাম কা ওয়াস্তে একটি নির্বাচন করানো হলেও, সেখানে বাশারের কোনও বিরোধী প্রার্থী ছিলেন না। ফলত, তিনি একাই নির্বাচনে লড়েন, একাই জেতেন এবং তারপর প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে বসে যান!
বাশার আল-আসাদ বেড়ে উঠেছিলেন তাঁর বাবা হাফিজকে দেখেই। হাফিজ আল-আসাদ সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধু ছিলেন এবং প্রায় তিন দশক ধরে সিরিয়া শাসন করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, বাশার আল-আসাদ ছিলেন তাঁর বাবার মেজো ছেলে। অর্থাৎ সরাসরি তাঁর পক্ষে হাফিজের উত্তরাধিকারী হওয়া সম্ভব ছিল না। তাই তিনি লন্ডনে চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসাবে পড়াশোনা করতে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু, ১৯৯৪ সালে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় বাশারের দাদা এবং হাফিজের বড় ছেলে বাসেলের মৃত্যু হয়।
এরপরই সিরিয়ার রাজনীতিতে বাশার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে তিনি মিলিটারি সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং কালক্রমে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর একজন কর্নেল হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন।
২০০০ সালে হাফিজের মৃত্যুর সময় বাশারের বয়স ছিল ৩৪ বছর। অথচ, সিরিয়ার তৎকালীন সংবিধান অনুসারে, প্রেসিডেন্ট হতে গেলে নূন্যতম বয়স ৪০ বছর হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু, হাফিজের মৃত্যুর পর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সিরিয়ার সংবিধান বদলে ফেলা হয়। যাতে বাশার আল-আসাদ পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতে পারেন! বস্তুত, হাফিজ মারা যাওয়ার একমাস পরই তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে বাশার সিরিয়ার সর্বোময় ক্ষমতা দখল করেন।
পশ্চিমী দুনিয়া এই বিষয়টিকে ভালো চোখে না দেখলেও বাশার নিজে সেই সময় দাবি করেছিলেন, তিনি সিরিয়াকে আধুনিকভাবে গড়ে তুলবেন। বাশারের এই ভাবমূর্তি তৈরি করতে বিশেষ সাহায্য করেছিলেন তাঁর স্ত্রী আসমা আল-আসাদ।
আসমার সঙ্গে বাশারের বিয়ে হয়েছিল ২০০০ সালে। আসমা আদতে সিরিয়ার মানুষ হলেও তিনি বড় হয়েছিলেন লন্ডনে এবং অতীতে একজন ব্যাঙ্কার ছিলেন।
কিন্তু, বাস্তবে বাশারের আমলে সিরিয়া কোনও উন্নতিই হয়নি বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট মহলের।
এই অবস্থায় ২০১১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সরাসরি বাশারের উদ্দেশে তোপ দেগে বলেন, তিনি নাগরিকদের হত্যা ও গণ-গ্রেফতারির রাজনীতি করে ক্ষমতায় টিকে রয়েছেন। এমনকী, বাশারকে হয় গণতন্ত্র কায়েম করার অথবা পদত্যাগ করার বার্তাও দেন ওবামা।
কিন্তু, তারপরও প্রত্যেকটি নির্বাচনে বাশার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠাতা নিয়ে জিতেছেন এবং দফায় দফায় ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। যদিও সেই ভোটাভুটি আদৌ বৈধ ছিল কিনা, তা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন তোলা হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালে এহেন একটি নির্বাচনে আবারও জেতেন বাশার আল-আসাদ।
অন্যদিকে, ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। সেই গৃহযুদ্ধ চলাকালীনই ২০১৩ সালে বাশার আল-আসাদের সরকারের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে রাষ্ট্রসংঘ। কিন্তু, এত কিছুর পরও বাশার আল-আসাদকে গদিচ্যুত করা যায়নি। যদিও ২০২৪ সালের অন্তিম লগ্নে অবশেষে তাঁর সেই আসন টলে গিয়েছে বলেই মত ওয়াকিবহাল মহলের।