উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন শুরু হতে একমাসেরও কম সময় বাকি। সাত দফায় ৪০৩ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে দেশের সর্ববৃহত রাজ্যে। এই নির্বাচনে যদি বিজেপি জিততে পারে তাহলে যোগী আদিত্যনাথ এক অনন্য রেকর্ড গড়বেন সেরাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাসে। এর আগে কোনও বারই পাঁচবছরের পূর্ণ মেয়াদ কাটিয়ে কোনও মুখ্যমন্ত্রী এই রাজ্যের মসনদে ফিরতে পারেননি। তবে সেই রেকর্ড গড়তেই উত্তরপ্রদেশে ঘঁটি সাজাচ্ছিল বিজেপি। তবে গেরুয়া শিবিরের সেই অঙ্ক মেলানোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিধায়কদের দলত্যাগ। ধর্মীয় লাইনে ভোটারদের বিভাজন করে ৮০ বনাম ২০ শতাংশের নিরিখে নির্বাচনে লড়তে চাইছিল বিজেপি। তবে সম্প্রতি বিজেপি ছেড়ে দলিত নেতাদের সমাজবাদী পার্টিতে যোগদানে ফের একবার জাতের অঙ্কে ফিরতে পারে উত্তরপ্রদেশের ভোট সমীকরণ। আর তা হলে বিজেপির পদ্ম থেকে পাপড়ি খসার সম্ভাবনা থাকবে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে বিজেপি ৬০-৪০ ফর্মুলাতে উত্তরপ্রদেশ দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। সেই নির্বাচনে বিজেপির ভোটের হার ছিল ৪৪ শতাংশ। সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টি সেই নির্বাচনে সম্মিলিত ভোট শতাংশ ছিল ৪০ শতাংশ। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোটের হার বেড়ে ৫০ শতাংশ হয়ে যায়। এই নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টি হাত মিলিয়ে লড়লেও তাদের সম্মিলিত ভোটের হার কমে ৩৭.৫ শতাংশ হয়ে যায়। আদতে বিজেপি উত্তরপ্রদেশের যাদব ও জাটদের ভোটের উপর নজর দেয় না সেভাবে। গোবলয়ের এই রাজ্যে যাদব ও জাটভরা সমাজবাদী পার্টিকে সমর্থন করে এসেছে দীর্ঘদিন ধরে। এই দুই সম্প্রদায় উত্তরপ্রদেশের ৪০ শতাংশ। তাছাড়া মুসলিমরাও ঝুঁকে থাকে অখিলেশের দলের দিকে।
জাতপাতের এই চিরাচরিত সমীকরণ ভেঙে বেরিয়ে বিজেপি হিন্দুদের এক করে নির্বাচনে লড়েছিল উত্তরপ্রদেশে। এর আগে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত ছিল উচ্চবর্ণ ও ব্রাহ্মণরা। সেখানে ২০১৭ সালে দলিতদেরকেও নিজেদের দিকে টানতে সক্ষম হয়েছিল বিজেপি। অখিলেশের যাদব-জাটভ ভোটব্যাঙ্কেও থাবা বসিয়েছিল বিজেপি। তবে সম্প্রতি মৌর্য সম্প্রদায়ের মন্ত্রী-বিধায়করা দল ছাড়ায় সমীকরণ বদলেছে। ভোটের নিরিখে মৌর্যরা সম্প্রদায় ৫ শতাংশ হলেও পূর্ব উত্তরপ্রদেশে বিজেপি গড় ফাটল ধরাতে পারে এই বিধাযক বিদায়ের ধারাবাহিকতা।
যদি জাতি বিন্যাসের মাধ্যমে বিজেপির জনপ্রিয়তা দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে, গত লোকসভা নির্বাচনে ব্রাহ্মণদের মধ্যে ৮২ শতাংশ বিজেপির দিকে ঝুঁকে, রাজপুতদের মধ্যে ৮৮ শতাংশ, বৈশ্যদের মধ্যে ৭০ শতাংশ, জাটদের মধ্যে ৯১ শতাংশ, অন্যান্য উচ্চবর্ণের মধ্যে ৮৪ শতাংশ, যাদবদের মধ্যে ২৩ শতাংশ, কুর্মিদের মধ্যে ৮০ শতাংশ, অন্যান্য ওবিসিদের মধ্যে ৭২ শতাংশ, জাটভদের মধ্যে ১৭ শতাংশ, মুসলিমদের মধ্যে ৮ শতাংশ বিজেপির দিকে ঝুঁকে। তবে ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণেক একাংশ ‘ঠাকুর’ সম্প্রদায়ের যোগীতে ক্ষুণ্ণ। আবার পূর্ব উত্তরপ্রদেশের ওবিসি নেতাদের সাইকেলে চড়িয়ে বিজেপির পালের হওয়া কাড়তে চাইছে সমাজবাদী পার্টি। যাদব-জাটভদের ভোট অক্ষত রেখে যদি অন্য দলিত সম্প্রদায়ের পথে সাইকেলের চাকার ছাপ ফেলা যায়, তাহলে গত নির্বাচনের অঙ্ক ঘোরাতে পারেন অখিলেশ।
গত কয়েকদিনে যোগীমন্ত্রিসভা ছেড়েছেন ৩ জন। এছাড়াও ৬ জন বিধায়ক পদ্ম ছেড়ে সাইকেল শিবিরে ভিড়েছেন। স্বামী প্রসাদ মৌর্য, দারা সিং চৌহান, ধরম সিং সাইনির হাত ধরে বিজেপির ওবিসি ভোট ব্যাঙ্কে থাবা বসাতে চাইছে সমাজবাদী পার্টি। বিজেপিকে সর্বপ্রথম ধাক্কা মেরেছিলেন স্বামীপ্রসাদ। এককালে বহুজন সমাজ পার্টি নেত্রী মায়াবতীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন স্বামীপ্রসাদ। ২০১৭ সালের নির্বাচনের আগে বিজেপিতে নাম লেখান স্বামীপ্রসাদ। যোগী মন্ত্রিসভায় শ্রমমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান। তবে আসন্ন নির্বাচনের প্রাক্কালেই সমাজবাদী পার্টির দিকে পা বাড়ান পাঁচবারের এই বিধায়ক। প্রসঙ্গত ২০১৭ সালে বিজেপি যখন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে উত্তরপ্রদেশে সরকার গঠন করেছিল, তখন রাজ্যে বিজেপি সভাপতি ছিলেন কেশব প্রসাদ মৌর্য। তিনি বর্তমানে উপ-মুখ্যমন্ত্রী। তবে দলিতদের একাংশের আশা ছিল, বিজেপি এক দলিতকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী করবে। তবে বিজেপি সেটা না করে দিল্লি থেকে উড়িয়ে এনে যোগীকে মসনদে বসিয়েছিল। আর এখন মৌর্য সম্প্রদায়ের সেই আবেগকে হাতিয়ার করেই বিজেপির ভোট ব্যাঙ্কে ভাঙন ধরাতে চাইছে সমাজবাদী পার্টি। এরমই ছোট ছোট ওবিসি সম্প্রদায়কে নিজেদের দিকে টানতে ছোট ছোট ‘পাস’ খেলছে সমাজবাদী পার্টি। অপরদিকে ৮০-২০ ফর্মুলার ডাক দিয়ে ছক্কা হাঁকাতে চলা বিজেপির কপালে তাই এখন চিন্তার ভাঁজ।