সুচরিতা সেনগুপ্ত
বাংলাদেশে আবার একটা ‘স্বাধীনতা’। যাকে বলা হচ্ছে, দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। প্রথম স্বাধীনতা অর্জনের গল্প ইতিহাস বইয়ের পাতায় লেখা হয়েছে। কিন্তু যে কথা ইতিহাস বইয়ে লেখা হলেও একেবারে পিছনের দিকে স্থান পেয়েছে, তা হল সেই সময়কালের উদ্বাস্তু বা শরণার্থী পরিস্থিতি। দ্বিতীয় স্বাধীনতাও কি আবার তেমনই এক পরিস্থিতি তৈরি করতে চলেছে? এটাই এখন বড় প্রশ্ন।
শরণার্থী সংকট সামলানো গোটা পৃথিবীর কাছেই বড় একটি চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে ভারতীয় সীমান্তে শরণার্থীর চাপ বাড়বে কি না, তা বোঝার জন্য বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর ধরে ঘটে চলা কিছু ঘটনার দিকে তাকাতে হবে এবং সাম্প্রতিক ইতিহাসের পর্যালোচনা করতে হবে।
বাংলাদেশের একদিকে ভারত, অন্যদিকে মায়ানমার। বিষয়টা সহজেই অনুমেয়, একটি দেশের একদিকের সীমান্তে চাপ বাড়লে, অন্যদিকে তার প্রভাব পড়বেই। যদি না মধ্যবর্তী দেশটি ততটাই স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে, যখন একদিকের চাপ সে নিজেই সামলে নিতে পারে। বাংলাদেশ দীর্ঘ দিন ধরেই রোহিঙ্গা শরণার্থী সামলানোর চেষ্টা করছে। বহু রোহিঙ্গা অনেক বছর ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। ইতিমধ্যে অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি আরও বহু উদ্বিগ্ন মানুষকে ভারতের সীমানার দিকে ঠেলে দিতে পারে। দু’টি ঘটনা আলাদা করে পর্যালোচনা করলে আগামী দিনের সম্পর্কে কিছুটা আভাস পাওয়া যেতে পারে।
রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে কেন?
২০২১ সাল থেকে মায়ানমারে গৃহযুদ্ধ লেগে রয়েছে। নির্বাচনে জয়ী ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি’-র সরকারকে ফেলে দিয়ে ক্ষমতার দখল নেয় দেশের সামরিক বাহিনী তাতমাদো। তার পর থেকেই মায়ানমার যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে মায়ানমারের আরাকান প্রদেশের গেরিলা বাহিনী আরাকান আর্মি লড়াই করছে দেশের ক্ষমতায় থাকা সেনার বিরুদ্ধে। এদিকে শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে নাকি প্রচুর রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য।
মায়ানমারে রোহিঙ্গারা যে এলাকায় থাকতেন, সেটাই হল রাখাইন স্টেট। সেখান থেকেই পালিয়ে আসতে হয়েছে তাঁদের। ফলে আরাকান আর্মির সঙ্গে তাঁদের শত্রুতা বহু দিনের। সেটিকেই কাজে লাগানো হচ্ছে মায়ানমারে। ফলে সুযোগ পেলেই আরাকান আর্মিও রোহিঙ্গাদের আক্রমণের চেষ্টা করে। সেটিই হয়েছে বর্তমান পরিস্থিতিতে।
বাংলাদেশে বর্তমানে সক্রিয় কোনও সরকার নেই। তাই নেই রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দেওয়ার মতো কেউ। ফলে আরাকান সেনারা নানা ভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে রোহিঙ্গাদের উপর। এমনকী ড্রোন আক্রমণেও গত কয়েক দিনে অনেকের মৃত্যু হয়েছে বলে শোনা গিয়েছে নাফ নদীর কাছে বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে। ফলে রোহিঙ্গারা আর বাংলাদেশের নিরাপদ আশ্রয়ে শান্তিতে আছেন সে কথা বলা যাবে না। এর ফলে কী হবে? ঠিক, অনেকে যা আন্দাজ করছেন— সেটিই, তাঁরা বাংলাদেশ ছেড়ে আরও নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেন। সেক্ষেত্রে ভারত সবচেয়ে হাতের কাছে।
অতীত থেকে বর্তমান কোন পথে এগিয়েছে?
বাংলাদেশে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প রয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সহযোগিতা (পরিচালনার ক্ষেত্রে) থাকলেও এগুলি বাংলাদেশ সরকারের আওতাভুক্তই। নিরাপত্তার দায়িত্ব পুরোপুরি বাংলাদেশে সরকারের হাতেই। নব্বইয়ের দশক থেকেই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে রয়েছেন। কিন্তু ২০১৭ সালটিকে ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলা হয় কারণ, সেই সময়ে শেখ হাসিনার সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ব্যাপক সংখ্যায় রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় পান। রাতারাতি শেখ হাসিনা তাঁদের কাছে হয়ে ওঠেন ‘মা’। ক্যাম্পে অনেকেই হাসিনা প্রসঙ্গে কথা বলার সময়ে তাঁকে ‘মা’ বলেই ডাকতেন।
হাসিনার প্রতি রোহিঙ্গাদের আবেগ যেমন ছিল, তেমনই এর অন্য একটি ব্যাখ্যাও অনেকে দেন। অনেকেই বলেন, হাসিনাও নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের কাজে লাগিয়ে থাকতে পারেন। বিশেষত কক্সবাজারের উখিয়া এলাকায় নির্বাচন পরিচালনার জন্য এমন অনেক রোহিঙ্গার ব্যবহার বহু বছর ধরে করা হত বলেই অনেকের মত।
কিন্তু ২০১৮ সালের পর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। বাংলাদেশ কথাবার্তা চালাতে শুরু করে মায়ানমারের সঙ্গে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কথাবার্তা চালানো শুরু হয়। তার কয়েক বছরের মধ্যেই মায়ানমারে শুরু হয় যুদ্ধ। ফলে মুলতুবি হয়ে যায় সেই কথাবার্তা। কিন্তু মাঝখান থেকে হাসিনার সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের ভালোবাসাটা হ্রাস পেয়ে যায়। ইতিমধ্যেই ক্যাম্পে বাড়তে থাকে হিংসাত্মক ঘটনা। তার উপর ফের মায়ানমারে ফিরে যাওয়ার চাপ— সবটা মিলিয়েই রোহিঙ্গারা কিছুটা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল তৎকালীন সরকারের উপর।
এই গোটা সময়েই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীরা, সেনাবাহিনী এবং পুলিশ। বর্তমান পরিস্থিতিতে যে নিরাপত্তাটাই আর নেই। ফলে আরাকান আর্মি এখন সীমানা পেরিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আক্রমণ চালাচ্ছে। এমনই খবর পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে।
ভারতের সীমান্তে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু শরণার্থীদের চাপ বাড়তে পারে কি?
এবার এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক। সংবাদমাধ্যম সূত্রে যা জানা গিয়েছে, তাতে ভারত এবং বাংলাদেশের সীমান্তে আরও কড়া নজরদারির ব্যবস্থা হচ্ছে। আমরা যদি অতীতের দিকেও তাকাই, তাহলে দেখব, বনগাঁ, গেদের মতো সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে প্রচুর মানুষ এর আগে গ্রেফতার হয়েছেন বেআইনি ভাবে সীমানা পেরোতে গিয়ে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আবার মহিলা। এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির মহিলা।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বড় অংশই আওয়ামি লিগকে ভোট দিতেন। এবং বর্তমানে সেই সব মানুষ কিছুটা চাপে থাকবেনই। তাতে ধর্মের ভূমিকা যদি নাও থাকে, রাজনৈতিক ভূমিকা তো থাকবেই। ফলে তাঁদের উপর আক্রমণ না হলেও, তাঁরা আতঙ্কে থাকবেন। এবার এই সব মানুষের মধ্যে যাঁরা অর্থনৈতিক ভাবে ব্যাপক মাত্রায় শক্তিশালী, তাঁরা কিছু দিনের জন্য বা পাকাপাকি ভাবে ইউরোপ বা আমেরিকায় চলে যেতে পারেন। প্রশ্ন হল একেবারে গরিব শ্রেণিকে নিয়ে?
দেখা গিয়েছে, যখনই কোনও দেশে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়, তখনই সেই দেশের সীমানায় অশান্তি বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে, তেমন কথা এখনই কেউ দিতে পারছেন না।
এবার প্রশ্ন হল, তাহলে কি ভয়ের চোটে ওই দেশের শুধু সংখ্যালঘুরাই ভারতে চলে আসার চেষ্টা করবেন? এমনটা ভাবার কারণ নেই। দেখা যায়, রাজনৈতিক অশান্তির সময়ে কোনও জনপদ আক্রান্ত হলে সেই এলাকায় আক্রমণকারীদের নিজেদের লোকেরাও কোল্যাটারাল ড্যামেজে আক্রান্ত হন। একথা সকলেই বোঝেন। ফলে সংখ্যালঘু হোক বা সংখ্যাগুরু— এক্সোডাস হলে, সকলেই জায়গা ছাড়তে চান। তাই বাংলাদেশে বর্তমানে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটছে কি না, সেটা যতটা বড় প্রশ্ন, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল— মানুষ তেমন আশঙ্কা করছেন কি না। যদি সেই আশঙ্কা থাকে, ভারতের সীমান্তে সব সম্প্রদায়ের মানুষেরই ভিড় বাড়বে।
এখন যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হতে চলেছে, সেই সরকার নিশ্চয়ই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার কথা বলবে। আগামী দিনে নির্বাচনে যে সরকার বাংলাদেশে আসবে, তারাও একই কথাই বলবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পুরোটা কি নেতৃত্বের হাতে আছে? যদি থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই চিন্তা নেই। যদি না থাকে, তাহলে বাংলাদেশে প্রচুর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতি উদ্বেগের হতে পারে।
আরও একটি কথা না বললেই নয়। অনেকেই দাবি করেন, বিএনপি যখনই ক্ষমতায় থেকেছে, ভারতে উদ্বাস্তু এবং শরণার্থীদের ভিড় বেড়েছে। সেই দাবি সঠিক হলে বলতে হবে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে ক্ষমতা বিএনপির হাতে গেলে আন্দোলনকারী ছাত্রদের সেই সরকারের উপর কতটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে, সেটিও ঠিক করে দেবে ভারতের সীমান্তে চাপের পরিমাণ।
ভারতের সীমান্তে কাদের ভিড় বাড়তে পারে? রোহিঙ্গা নাকি বাংলাদেশের অন্য মানুষ?
ভারতীয় সীমান্তে শরণার্থী চাপ বাড়লে সংখ্যালঘু এবং ওই দেশের নাগরিকদের সংখ্যা সেখানে বেশি হতে বাধ্য। অনেকেই ভাবছেন, রোহিঙ্গারাও হয়তো ওই দেশ ছাড়তে চাইবেন। কিন্তু যতই সংকটে থাকুন না কেন, তাঁদের সংখ্যা বেশি হবে না, তার কারণ হল— বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বেশির ভাগ রোহিঙ্গার মত, এটি বাংলাদেশের ভিতরের ব্যাপার, তাঁদের মাথা না ঘামালেও চলবে। পাশাপাশি মহম্মদ ইউনুসকে নিয়ে তাঁদের অনেকের মধ্যেই আশাব্যঞ্জক মনোভাব রয়েছে। অনেক রোহিঙ্গার বিশ্বাস, ইউনুস ভবিষ্যতে তাঁদের জন্য পাকাপাকি বন্দোবস্ত করবেন বাংলাদেশের মাটিতেই।
আরও একটি মজার কথা, রোহিঙ্গাদের ভাষা বাংলার অনেক কাছাকাছি হলেও, ক্যাম্পের অনেক কম বয়সিরাই সংস্কৃতিগত ভাবে পাকিস্তানকে অনুসরণ করতে পছন্দ করেন। বাংলা গানের চেয়ে ওখানে পাকিস্তানের গান বেশি জনপ্রিয়, পোশাকের ক্ষেত্রেও রোহিঙ্গারা পাকিস্তানের মানুষের সাজই বেশি অনুসরণ করতে চান। ফলে বাংলাদেশ ছাড়তে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তাঁরা হয়তো পাকিস্তানকে তাঁদের লক্ষ্য হিসাবে বেছে নিতে চাইবেন। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক (কিছু রোহিঙ্গাও নাগরিকত্ব পেয়েছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে) যাঁরা, বিশেষ করে ওই দেশে যাঁরা সংখ্যালঘু সীমান্তে তাঁদের ভিড় আরও বাড়তেই পারে। আগামী দিনে বাংলাদেশের সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ করছে, তার উপরই নির্ভর করবে এই সব মানুষের আতঙ্ক হ্রাসবৃদ্ধি, এবং দুই দেশের সীমানার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা।
(লেখক দক্ষিণ এশিয়ার শরণার্থী সংকট নিয়ে গবেষণারত, বর্তমানে ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপে কর্মরত এবং গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট জেনিভার পূর্বতন গবেষক)