সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যা পুঁজি করেও গত সত্তর বছর ধরে ছেলে-বুড়ো সকলকে শিক্ষাদান করে চলেছেন ১০২ বছর বয়েসি ‘নন্দ মাস্টার’। শিক্ষার বিকাশে তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দিতে সোমবার পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করল কেন্দ্রীয় সরকার।
প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে এবার যে ১০২ জনকে পদ্ম সম্মান জানানো হল, তাঁদেরই একজন ওড়িশার যাজপুর জেলার কান্টিরা গ্রামের বাসিন্দা নন্দ কিশোর প্রুস্তি। ওড়িশার ঐতিহ্যশালী ‘চটশালি’ বা টোল শিক্ষাদান প্রথার তিনিই সম্ভবত একমাত্র জীবিত প্রতিনিধি। প্রতিদিন ভোরে তাঁর বাড়ির এই টোলে শিক্ষালাভ করতে হাজির হয় শিশুরা। খুদে পড়ুয়াদের ওড়িয়া অক্ষরমালা ও গণিতের সাধারণ পাঠ দেন নন্দ কিশোর। আবার সন্ধ্যা ৬টায় টোলে উপস্থিত হন বয়স্ক ছাত্ররা, যাঁরা এখনও নাম সই করতে জানেন না।
নন্দ নিজেও হয়ত এমনই নিরক্ষর থাকতেন যদি না শৈশবে তাঁকে যাজপুরের মামাবাড়িতে না পাঠানো হত। সেখানে থেকেই ইংরেজ শাসিত ভারতে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের প্রাথমিক পাঠ সম্পূর্ণ করার পরে কটকে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন তাঁর মামা। কিন্তু তাতে আপত্তি তোলেন নন্দর বাবা। মামাবাড়ির পাট চুকিয়ে বাবাকে খেতের কাজে সাহায্য করতে বাড়ি ফিরতে হয় নন্দ কিশোরকে।
গ্রামে সেই সময় কোনও স্কুল ছিল না। এই কারণে শিশুদের মধ্যে পুঁথিগত শিক্ষার অভাব লক্ষ্য করেন নন্দ। বিষয়টি তাঁকে ভাবায়। তাই নিজের সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত আরব্ধ শিক্ষা সম্বল করেই শিশুদের লেখাপড়ার সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে উদ্যোগী হন নন্দ কিশোর, এবং অবশ্যই বিনামূল্যে।
তাঁর নিজের কথায়, ‘দেখতাম ছেলেমেয়েদের মধ্যে পড়াশোনার কোনও চর্চাই নেই। সকলেই অশিক্ষিত। আমি তাদের গাছতলায় পড়াতে শুরু করলাম। প্রথম দিকে গিয়ে ধরে আনতে হত, কিন্তু ক্রমে ওদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তৈরি হল। আমি শুধু চাই ওরা বড় হয়ে ভালো মানুষ তৈরি হোক।’
এ ভাবেই গ্রামের তিন প্রজন্মকে একক চেষ্টায় শিক্ষিত করার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন নন্দ মাস্টার। বিনিময়ে আশা করেননি এক পয়সাও।
বর্তমানে কান্টিরা গ্রামের কাছেই গড়ে উঠেছে স্কুল ও কলেজ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার প্রতি আগ্রহও বেড়েছে নিঃসন্দেহে। তবু এখনও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় হাতেখড়ির জন্য নন্দ মাস্টারের চটশালিতেই পাঠাতে পছন্দ করেন গ্রামের মানুষ। সেই আস্থা পূরণে আজও সাবলীল শতায়ু নন্দ কিশোর হেসে বলেন, ‘যত দিন শরীর ভরসা দেবে, শিশুদের পড়িয়ে যাব।’