ভারতীয় সেনাবাহিনীর টহলদারী পথে চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মির নজরদারি ঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনাই গালওয়ান উপত্যকায় দুই পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূত্রপাত করে, ঘটনাক্রমের সমন্বয়ে এই তথ্য জানতে পেরেছে হিন্দুস্তান টাইমস।
বিতর্কিত নজরঘাঁটি তৈরি করতে পারলে কারাকোরাম পর্বতমালার দিকে ভারতীয় সেনার গতিবিধি লক্ষ্য করা ছাড়াও ডারবুক-শিয়ক-দৌলত বেগ ওল্ডি রোড ধরে ভারতের সামরিক যান চলাচলের খবরও রাখতে পারত চিনা সেনা। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, নজরমিনারটি প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার ভারতীয় অংশে তৈরি করার মতলব ফেঁদেছিল চিন।
গালওয়ান উপত্যকা সংঘর্ষ নিয়ে চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়্যাং লি-র সঙ্গে ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকরের ফোনালাপে বিষয়টি গুরুত্ব পেলেও আসল কথা হল, সীমান্ত থেকে সেনা সমাগম হালকা করার ছলে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা সীমা পরিবর্তনের ছক কষেছিল পিএলএ। এই প্রক্রিয়ায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর পয়েন্ট ১৪ টহলদারি সীমানা নিজেদের কুক্ষিগত করার পরিকল্পনা ঠান্ডা মাথায় ছকেছিল বেজিং। বলা বাহূল্য, এর ফলে ভারতের বড়সড় ক্ষতি হয়ে যেত।
১৯৭৮ সালে পাহাড়ের উপরে যে জায়গায় পয়েন্ট ১৪ নির্মাণ করে ভারতীয় সেনা, সেখান থেকে গালওয়ান উপত্যকা এবং শিয়ক নদীর উপনদী গালওয়ান নালা দেখা যায়। এই শিয়ক নদীর তীরেই ডিএসবিও রোড নির্মাণ করেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়াররা।
সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় আধিকারিক এবং প্রাক্তন কর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পরে হিন্দুস্তান টাইমস জানতে পেরেছে যে, গত ৬ জুন ভারত ও চিনের সামরিক কম্যান্ডারদের মধ্যে বৈঠকে পয়েন্ট ১৪ পর্যন্ত প্রতিটি পয়েন্টে সৈন্য সংখ্যা পর্যন্ত নির্ধারিত হয়। কিন্তু এর পরে সীমান্ত থেকে সেনা সমাগম কমানো শুরু করলেও পয়েন্ট ১৪-র কাছে একটি নজরদারি মিনার গড়ার পরিকল্পনা করে চিনা ফৌজ। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, সেনা সরানোর প্রক্রিয়ায় নজর রাখতেই এই নজরঘাঁটির প্রয়োজন। কিন্তু তাতে তীব্র আপত্তি জানান বৈঠকে উপস্থিত ১৬ নম্বর বিহার রেজিমেন্টের কম্যান্ডিং অফিসার কর্নেল সন্তোষ বাবু, যিনি বুঝতে পেরেছিলেন সেনা প্রত্যাহার নীতি লঙ্ঘন করার চেষ্টায় রয়েছে চিন।
সোমবার সন্ধ্যা নাগাদ কর্নেল সন্তোষ বাবু ও তাঁর সেনা কম্যান্ডার পয়েন্ট ১৪ পর্যন্ত পৌঁছে তাঁর সমপর্যায়ের চিনা সামরিক অফিসারকে নির্মীয়মাণ নজরঘাঁটি ভেঙে ফেলার অনুরোধ জানান। সেই অনুরোধ না মানায় দুই পক্ষের কথা কাটাকাটি শুরু হয় যা ক্রমে প্রবল উত্তেজনা ছড়ায় ও ভারত ও চিনের সৈন্যরা ঘটনাস্থলে জড়ো হতে শুরু করেন। গালওয়ান নালার কাছে পাহাড়ের ওপরে থাকা সেনাঘাঁটি থেকে দলে দলে চিনা সেনা হাজির হতে থাকলে একসময় তা ভারতীয়দের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যায় গিয়ে দাঁড়ায়।
এই সময় দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় হাতাহাতি। প্রায় ৬০০ সেনার ধস্তাধস্তিতে এক সময় সরু পাহাড়ি পথ ধসে পড়ে গালওয়ান নালার বরফঠান্ডা জলে গিয়ে পড়েন ভারতীয় জওয়ানরা। ১৬,০০০ ফিট উচ্চতায় শূন্যের বেশ নীচে থাকা তাপমাত্রায় ভিজে কাপড়ে নদী থেকে ওঠার চেষ্টা করেন তাঁরা। তীব্র ঠান্ডা সহ্য করতে না পেরে অনেকেরই সেখানে মৃত্যু হয়।
এ ভাবেই নিজেদের জীবনের আত্মাহুতি দিয়ে পয়েন্ট ১৪ রক্ষা করে দেশের সার্বভৌমত্ব অখণ্ড রাখেন কর্নেল সন্তোষ বাবু ও তাঁর সৈন্যরা। তাঁদের সাহসিকতার জন্যই শেষ পর্যন্ত চিনের জমি দখলের ফন্দি ভেস্তে যায়।