শুক্রবার ভারত-চিন স্টাডি গ্রুপের বৈঠকের পর আগামী সপ্তাহে দু'দেশের কমান্ডার পর্যায়ের বৈঠকের মঞ্চ প্রস্তুত হয়েছে। সেই বৈঠকে লাদাখ থেকে সেনা সরানো এবং উত্তেজনা প্রশমনের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে সামরিক পর্যায়ের বৈঠকের ফলাফল কী হবে, তা অনেকাংশে লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর চিনের অবস্থান এবং অধিকৃত আকসাই চিনে সেনা মোতায়েনের উপর নির্ভর করবে। সেক্ষেত্রে এই বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে -
আকসাই চিনে সৈন্য সমাবেশ বৃদ্ধি করেই চলেছে পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)। একইসঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরো বরাবর ফৌজিদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মোতায়েন করছে। তা থেকেই কার্যত স্পষ্ট হচ্ছে, দীর্ঘ সময় ধরে সীমান্তে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে চিন।
বিশেষ প্রতিনিধি (৫ জুলাই) এবং বিদেশমন্ত্রী (১০ সেপ্টেম্বর) পর্যায়ের বৈঠকে সেনা সরানো এবং উত্তেজনা প্রশমনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। শর্তসাপেক্ষে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সহমত হয়েছে চিন। সেই শর্তের জেরে পুরো প্রক্রিয়াটি হোঁচট খেয়েছে। পুরোপুরি পশ্চাদসরণের পরিবর্তে প্যাংগং সো লেকের উত্তর তীরের ভূখণ্ডে নিজেদের ছাপ রেখে দিতে যায় বেজিং। বৈঠকে চিন ফিঙ্গার এইট থেকে সরে যাওয়ার কথা বলেছিল। অর্থাৎ এপ্রিলের সময়কার অবস্থানে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু বর্তমান অবস্থানে (ফিঙ্গার ৪-এর আট কিলোমিটার) ৫০ জন ফৌজি রেখে যাওয়ার দাবিদাওয়া জানাতে থাকে। ভারতীয় গতিবিধির উপর নজরদারি চালানোর জন্য কয়েকটি জায়গায় ক্যামেরা লাগিয়ে যাওয়ার দাবি জানায় চিন। অর্থাৎ ভবিষ্যতে আবার ঝামেলা পাকানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখাই ছিল শি জিনপিংয়ের দেশের উদ্দেশ্য। সেই প্রস্তাব যথারীতি খারিজ করে দেয় ভারত।
প্যাংগং সো লেকের উত্তর তীরে পৌঁছে গিয়েছে চিনা সেনা। তেমনই লেকের দক্ষিণ তীরে পৌঁছে গিয়েছে ভারত। এই অবস্থায় লাদাখে ১,৫৯৭ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর শান্তি ও সুস্থিতি ফিরিয়ে আনার একটাই উপায় - দু'দেশের সেনাই নিজেদের বেস ক্যাম্পে ফিরে যাবে। ভারতীয় সেনা সেই কাজ করতে রাজি হলেও অনড় রয়েছে চিন। তাদের ভয়, পিছিয়ে গেলে যদি বিশ্বে মুখ পুড়ে যায়, নিজেদের দুর্বল মনে হয়।
চিনের প্রকৃত অভিপ্রায় নিযে ধোঁয়াশা আছে। ভারতীয় সেনা নিশ্চিত যে জরবদখল করা ভূখণ্ড নিজেদের অধীনেই রাখতে চাইছে চিন।
আগামিদিনে লাদাখ সীমান্তে আবহাওয়া ক্রমশ খারাপ হতে চলেছে। তার জেরে অভিযান শুরুর পরিবর্তে আত্মরক্ষার পথ বেছে নেবে দু'দেশই। প্যাংগং সো লেক এবং চুশুলে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ২৫ ডিগ্রি নীচে নেমে যাওয়া একেবারেই স্বাভাবিক বিষয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বুলেটের থেকে বেশি বিপজ্জনক আবহাওয়া।
চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের সুরক্ষার জন্য পাকিস্তানি সেনার মাধ্যমে চাপ দিচ্ছে বেজিং। সেই পরিস্থিতিতে পাাকিস্তান অধিকৃত গিলগিট-বালটিস্তানে পঞ্চম প্রদেশ তৈরির পথে হেঁটেছে ইসলামাবাদ। একইসঙ্গে সেই করিডরের আরও সম্প্রসারণ করতে চায় চিন। পশ্চিম এশিয়া, আফগানিস্তান এবং আফ্রিকা থেকে খনিজ ও হাইড্রোকার্বন আমদানির জন্য মালাক্কা প্র্ণালীর বিকল্প হিসেবে সেই করিডর গড়ে তুলতে চাইছে বেজিং।
চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর সম্প্রসারণের মাধ্যমে তিব্বতের বৌদ্ধ এবং শিংজিনাংয়ের মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্য নিচ্ছে চিন। কারণ আর্থিক বৃদ্ধির ফলের সামরিক খাতে আরও অর্থ ঢালা যাবে। আর সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে স্বশাসিত অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব আরও বাড়াতে পারবে চিন। ইতিমধ্যে বৌদ্ধ এবং শিংজিনাংয়ে বায়ুঘাঁটি সম্প্রসারণের কাজ চালু করেছে বেজিং। ক্ষেপণাস্ত্রও মোতায়েন করা হচ্ছে।
লাহসা থেকে কাশগড় পর্যন্ত ২১৯ নম্বর হাইওয়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে লাদাখে দৌলত বেগ ওল্ডি থেকে চুমার পর্যন্ত আগ্রাসী পদক্ষেপ করছে চিন। একইসঙ্গে সিয়াচেন হিমবাহের উত্তরে খুঞ্জেরাব পাসের মধ্যে দিয়ে যে রাস্তা আছে, তার পালটা হিসেবে কারাকোরাম পাসের মধ্য দিয়ে সমান্তরাল হাইওয়ে তৈরির করার জন্য ভারতের উপর চাপ দেওয়ার চেষ্টা করছে চিন।
চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের জন্য বড়সড় পরিকল্পনা থাকায় ভারতের সঙ্গে সীমান্ত দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী নয় চিন। কারণ সেক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় চিনের স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে।
পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং মায়ানমার এখন কাছাকাছি এসেছে। আবার ভুটানের সীমান্ত নিয়ে নাক গলাচ্ছে চিন। একবার সেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ার পর থিম্পুর সঙ্গে চিনের কূটনৈতিক সম্পর্কের পরিসর আরও বাড়বে। আর সেই দেশও নেপালের রাস্তায় হাঁটলে চারিদিক দিয়ে ভারতকে ঘিরে যাবে ভারত।