প্রত্যাশিতই ছিল। সীমান্তে ভারত-চিন উত্তেজনা নিয়ে নয়াদিল্লির উপর চাপ বাড়ানোর পথে হাঁটল বেজিংয়ের সরকারি সংবাদমাধ্যম। রীতিমতো কড়া সুরে 'পরামর্শ' দিল, 'সীমান্ত বিতর্কে প্ররোচনা দেওয়ার পরিবর্তে (করোনাভাইরাস) মহামারী নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনীতি চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে ভারতের সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।'
গত কয়েকদিন ধরেই সীমান্তে দু'দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। এই অবস্থায় চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস পরোক্ষভাবে ভারতের উপর চাপ বাড়াতে তৎপর হয়। সম্প্রতি দাবি করা হয়, বেজিংয়ের প্রথম ঘরোয়াভাবে বানানো হেলিকপ্টার-ড্রোন - এআর৫০০সি স্বয়ংক্রিয় হেলিকপ্টারটি ভারত-তিব্বত সীমান্ত বরাবর মোতায়েন করা হতে পারে। সীমান্তের ১৫,০০০-১৬,০০০ ফুট এলাকায় নিজের কেরামতি দেখাতে পারবে নয়া হেলিকপ্টার-ড্রোন। যা কিনা সমুদ্রপৃষ্ঠের ৫,০০০ মিটার উঁচু থেকে উড়তে পারবে এবং ৬,৫০০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছাতে সক্ষম। ঘণ্টায় ১৭০ কিলোমিটার গতি সম্পন্ন হেলিকপ্টারটি একটানা পাঁচ ঘণ্টা উড়তে পারবে বলে দাবি করা হয়েছে।
গ্লোবাল টাইমস প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, উচ্চ এলাকায় আঘাত হানা, বিপক্ষের বৈদ্যুতিন ব্যবস্থায় ব্যাঘাত আনার মতো ক্ষমতা রয়েছে নয়া হেলিকপ্টারের। বহুমুখী এবং সহজেই পরিচালিত করা ড্রোনটি চিনের দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারতীয় সীমান্তে সুরক্ষা নিশ্চিত করবে বলে দাবি করেছেন বেজিংয়ের বিশেষজ্ঞরা।
সরকারি সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, 'এআর৫০০সি-র পরীক্ষামূলক উড়ান হয়েছে যখন চিন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনার পারদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ চিনা ভূ-খণ্ডের মধ্যে গালওয়াল উপত্যকা এলাকায় ভারতের সাম্প্রতিক অবৈধ প্রতিরক্ষা পরিকাঠামো নির্মাণের জবাবে চিনের সীমান্তরক্ষী বাহিনী সীমান্তে নিরাপত্তা সংক্রান্ত পদক্ষেপ জোরদার করেছে।'
সীমান্তে উত্তেজনার পরিস্থিতিতে চিনা সংবাদমাধ্যমে এরকম 'আগ্রাসী' প্রতিবেদনে অবশ্য অবাক নয় কূটনৈতিক মহল। বিশেষজ্ঞদের মতে, সীমান্তে উত্তেজনার জন্য ভারতে ঘাড়ে দোষ চাপানোর একটি অংশমাত্র এটা। ২০১৭ সালে ডোকলাম রেষারেষির সময়ও একইভাবে আগ্রাসী ও ভারত-বিরোধী অবস্থান নিয়েছিল বেজিংয়ের সরকারি সংবাদমাধ্যমগুলি। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, আগামী কয়েকদিনে বরং সীমান্ত বরাবর এলাকায় চিনা সামরিক মহড়ার খবর এলে তা মোটেই আশ্চর্যজনক হবে না।
বিশেষজ্ঞদের সেই পর্যবেক্ষণ যে কতটা ঠিক, গ্লোবাল টাইমসের নয়া একটি কলামে তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। সীমান্তে নতুন করে উত্তেজনা ছড়ানো কোনও ‘দুর্ঘটনা’ নয়, বরং তা পরিকল্পিতভাবে নয়াদিল্লি করেছে বলে দাবি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কয়েকজন ভারতীয়ের বিশ্বাস, চিনের আর্থিক বৃদ্ধির হার এবং কয়েকটি পশ্চিমী দেশের দোষারাপের ফলে তাঁদের সামনে বড় সুযোগ রয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে যা সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁদের সুবিধাজনক অবস্থান হবে।’
যদিও ইতিমধ্যে বেজিংয়ের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে ভারত। বরং নয়াদিল্লি দাবি করেছে, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর টহলদারিতে বাধা দিয়েছে চিন। গত সপ্তাহে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেন, 'প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) বরাবর পশ্চিমাংশ (লাদাখ) বা সিকিম সেক্টরে ভারতীয় বাহিনী কোনও পদক্ষেপ করার দাবি ঠিক নয়। নিরাপত্তা বাহিনীর সবরকম কাজ হয়েছে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারতীয় ভূ-খণ্ডে।'
শুধু ভারত নয়, ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধেও আগ্রাসী মনোভাব নিয়েছে চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যম। তাদের দাবি, কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে যে দাবি করা হচ্ছে বিশ্বে একঘরে হয়ে গিয়েছে বেজিং, তা একেবারেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে বিরোধ থাকার অর্থই আন্তর্জাতিক স্তরে একঘরে হওয়া নয় এবং আমেরিকায় যে 'আন্তর্জাতিক মহল' নয়, সেই ‘পরামর্শ’ দেওয়া হয়েছে। নয়াদিল্লিকে বিশেষভাবে পরামর্শ দিয়ে গ্লোবালস টাইমসে বলা হয়েছে, ‘যদিও হাতেগোনা কয়েকটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক সংস্থা ট্রাম্প প্রশাসনের মত উগরে দিচ্ছে, ভারতীয় সরকারের উচিত শান্ত থাকা উচিত যাতে তারা আমেরিকার লেজুড় হিসেবে ব্যবহৃত না হয়।’
পরামর্শের পাশাপাশি ভারতকে খোঁচার আড়ালে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিতেও ছাড়েনি গ্লোবাল টাইমস। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যদিও আমেরিকার সঙ্গে চিনের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ, ১৯৬২ সালের তুলনায় চিনের জন্য (এখন) আন্তর্জাতিক পরিবেশ অনেক ভালো। যখন চিনের সঙ্গে ভারত একটি সীমান্ত যুদ্ধ শুরু করেছিল এবং যাতে চিনের বাজেভাবে হাতে পরাজিত হয়েছিল। ১৯৬২ সালে চিন এবং ভারতের জাতীয় সম্পদ তুলনার মতো ছিল। বর্তমানে তার একেবারে ভিন্ন ছবি হিসেবে ভারতের থেকে চিনের জিডিপি পাঁচ গুণ বেশি।’