চতুর্থ দফার লকডাউনের শেষের যে আশঙ্কা করেছিলেন কেন্দ্রের একাধিক আধিকারিক, সেটাই কার্যত সত্যি হল। আনলক ১-এর প্রথম সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার এবং ওড়িশায় হু হু করে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
গত মাসের শেষ আটদিনে পশ্চিমবঙ্গে যেখানে ১,০৪২ জন সংক্রামিত হয়েছিলেন, জুনের প্রথম আটদিনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩,৩০০। একই অবস্থা ঝাড়খণ্ডের। চতুর্থ দফা লকডাউনের শেষ আটদিনে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ২৫০। সেখানে জুনের প্রথম আটদিনে নতুন করে ৬৮০ জনের শরীরে ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। ওড়িশায় আবার ৩১ মে সংক্রামিতের সংখ্যা ছিল ১,৯৪৮। গত ৮ জুন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৯৯৪। অথচ গত ২৪ মে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১,৩৩৫।
ওড়িশা সরকারের দাবি, পরিযায়ী শ্রমিকরা ফেরার ফলে রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। নাম গোপন রাখার শর্তে এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, ‘গত ১৫ দিনে ১,৫৫৭ টি করোনা কেসের হদিশ মিলেছে। গড়ে ১০০ টি কেস ধরা পড়েছে। যে কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রগুলিতে পরিযায়ী শ্রমিকরা আছেন, সেখান থেকেই ৮০ শতাংশের বেশি কেস পাওয়া গিয়েছে। চিন্তার বিষয় হচ্ছে যে নতুন কেসগুলির হদিশ গ্রামীণ ওড়িশা থেকে মিলছে।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি মেডিক্যাল কলেজের এক এপিডেমিয়োলজিস্ট বলেন, ‘স্থানীয় সংক্রমণ নিশ্চিতভাবে হচ্ছে এবং তা মোকাবিলা করার জন্য সরকারকে নির্দিষ্ট কৌশল তৈরি করতে হবে।’
পরিযায়ী শ্রমিকরা আসার পর থেকে বাংলায় আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, তা আগে থেকেই স্পষ্ট ছিল। তা নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে বাকযুদ্ধে জড়িয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারও। একই সুরে মঙ্গলবার রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য কেন্দ্রকে দোষারোপ করেন তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও'ব্রায়েন। তিনি বলেন, 'আমি কেন্দ্রের কাছে জানতে চাই, কে ভারতীয় রেল চালায়? কে ট্রেনে পরিযায়ী শ্রমিকদের গবাদি পশুর মতো ঠেসে দিয়েছে?' যদিও বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের পালটা দাবি অভিযোগ, ‘তৃণমূল সরকারের ব্যর্থতার জন্য পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ।’
তবে বিজেপির জোট শরিক নীতিশ কুমারের বিহারেও একই অবস্থা। সেখানে করোনা আক্রান্তের অধিকাংশই পরিযায়ী শ্রমিক। বিহারের স্বাস্থ্য সচিব লোকেশ কুমার বলেন, ‘পরিযায়ী শ্রমিকদের কারণে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। মে'র শেষ সপ্তাহ থেকে মোট আক্রান্তের মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের হার ৬৬ শতাংশ থেকে ৭২ শতাংশ হয়েছে।’ গত ৩ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত বিহারে ১,৪৯১ টি ‘শ্রমিক স্পেশ্যাল’ ট্রেন চলেছে। বাড়ি ফিরেছেন কমপক্ষে ২০ লাখ শ্রমিক।
অধিকাংশ রাজ্যের আধিকারিকদের বক্তব্য, গুজরাত, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, দিল্লির মতো করোনা কবলিত জায়গা থেকে শ্রমিক ট্রেন এসেছে। ফলে সংক্রমণের হার বেড়েছে। সেই আশঙ্কাটা আগেই অবশ্য প্রকাশ করেছিল কেন্দ্রের আধিকারিকরা। তাঁদের বক্তব্য ছিল, শ্রমিকরা রাজ্যে ফেরার ফলে পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে। আর শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্রামেও করোনার দাপট বাড়বে।
ঝাড়খণ্ডে গত ৩১ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্তের হদিশ মিললেও ১ মে থেকে পরিযায়ী শ্রমিকের ফিরতে থাকার পর থেকেই সংক্রামিতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তবে শুধু সেই কারণই নয়, পরীক্ষা না হওয়া নমুনার ফলাফল জুনের প্রথম দিক থেকে আসতে শুরু করায় রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। স্বাস্থ্য সচিব নীতিন কুলকার্নি বলেন, ‘পরীক্ষার জন্য অনেক নমুনা জমা পড়েছিল (১ জুন পর্যন্ত প্রায় ১৩,০০০)। জুনের প্রথম সপ্তাহে সেগুলির ফল আসতে শুরু করে। যা করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ।’
একইসঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে তুলে ধরেছেন ঝাড়খণ্ড সরকারের রাজেন্দ্র ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সসের অধিকর্তা ডি কে সিং। তিনি বলেন, ‘শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট দলের (যাঁরা কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রে আছেন) পরীক্ষা করা হচ্ছে। গোষ্ঠী থেকে নমুনা আসছে না। তাই আনলক ১-এর প্রকৃত প্রভাব মূল্যায়ন করা জটিল।’ আর তাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।